চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সুমি বলল, নিজের জন্য করলেও পারতে।
তারপর চায়ে চুমুক দিল। চুমুক দিয়ে বলল, মা, ভেবে দেখলাম টেলিফোনটা বিক্রি করে ফেলাই ভাল।
পারু চুপ করে রইলেন।
সুমি আবার চায়ে চুমুক দিল। হাজার তিরিশেক টাকা পেলে কয়েকটা মাস মোটামুটি চলা যাবে।
পারু গম্ভীর গলায় বললেন, টেলিফোন আমি বিক্রি করে ফেলেছি।
সুমি চমকালো। কী?
হ্যাঁ। তিরিশ হাজারই দাম।
কার কাছে বিক্রি করলে?
ওই তো পাশের বাড়ির ওদের কাছে। তোকে বলেছিলাম না।
সুমি একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, টাকা দেবে কবে?
দিন দশেক পর। টাকা দিয়ে তারপর ফোন নেবে।
পারু আর দাঁড়ালেন না।
চায়ের কাপ হাতে সুমি তখন কী রকম স্তব্ধ হয়ে আছে।
.
০৭.
হোয়াইট হাউস হোটেলের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে মনজু বলল, প্রথমে ক্যাব থেকে, আই মিন ইয়েলোক্যাব থেকে আমার লাগেজ আনতে বলুন।
রিসেপসনিস্ট সঙ্গে সঙ্গে একজন বেয়ারাকে ডাকল। মনজুর লাগেজ আনতে বলল।
মনজু বলল, এখন রুম।
রিসেপসনিস্ট বিনীত গলায় বলল, আপনি একা, স্যার?
হ্যাঁ একা। কিন্তু রুম লাগবে ডাবল বেডের।
জ্বী?
জ্বী। তবে দুজন শোয়ার এক বিছানা নয়। সিঙ্গেল দুটো বেড। মাঝখানে স্পেস থাকতে হবে।
রিসেপসনিস্ট চোখ তুলে তাকাল।
মনজু হাসল। একা থাকব কিন্তু বিছানা দরকার দুটো।
ওকে স্যার।
আপনি কি অন্যকিছু ভাবছেন?
নো স্যার। নো।
আসলে এক বিছানায় থাকতে আমার খুব বোর লাগে। রাতের। অর্ধেকটা এক বিছানায়, বাকি অর্ধেকটা আরেক বিছানায়।
বলেই কেলানো একটা হাসি হাসল মনজু। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।
রিসেপসনিস্ট হাসল। নো প্রবলেম স্যার। ওরকম রুম আমাদের আছে।
তাহলে আর দেরি কেন? দিয়ে ফেলুন একটা।
এসি রুম, না ননএসি?
অফকোর্স এসি। নিউইয়র্কের কুইন্সে থাকি। গরমের সময় বেজায় গরম, আর শীতের সময় …।
রিসেপসনিস্ট যুবকটা একটু বেশি স্মার্ট। মনজুর কথা শেষ হওয়ার আগেই তার মুখের কথা যেন কেড়ে নিল। বেজায় শীত।
মনজু বলল, নো নো। ডিরেক্ট বরফ।
ও।
শুনুন, রুমটা আমার অনেকদিনের জন্য লাগবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে যতদিন থাকব।
তারপর আচমকা বলল, আপনি অংক কেমন জানেন?
রিসেপসনিস্ট ভড়কে গেল। জ্বী?
আড়াইমাসে কতদিন হয় বলুন তো?
রিসেপসনিস্ট ক্যালকুলেটর বের করতে যাবে, মনজু বলল, এত কষ্টের দরকার নেই। আমিই বলছি। পঁচাত্তর দিন। সেভেনটি ফাঁইভ ডেইজ। আপনাদের হোয়াইট হাউজ আমার পছন্দ হয়েছে। আমার যা পছন্দ হয়, আমি তার শেষ পর্যন্ত দেখি।
আবার সেই কেলানো হাসি হাসল মনজু। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মনজু তারপর রুমে এল। রুমে এসে টের পেল তার খুবই ক্লান্ত লাগছে এবং খুবই খিদে পেয়েছে। ক্লান্তি কাটাবার জন্য এখন হেভি একটা গোসল দরকার। গোসলের পর সম্পূর্ণ বাঙালি ভুঁড়িভোজ। তারপর ঘুম। কাল সকালে ফ্রেস মানুষ মনজু।
তাহলে মনজুর এখন কী করা উচিত? প্রথমে গোসল নাকি খাবারের অর্ডার?
খাবারের অর্ডারই আগে দেয়া উচিত। অর্ডার দিয়ে বাথরুমে ঢুকবে। বেরিয়ে আসতে আসতে খাবারও এসে যাবে।
গুড আইডিয়া।
মনজু টেলিফোন তুলল। কে ফোন ধরল না ধরল ভাবলই না। বলল, সুটকিভর্তা হবে?
যে ফোন ধরেছিল সে একটু ভড়কে গেল। জ্বী?
এত অবাক হচ্ছেন কেন? সুটকিভর্তা লোকে খায় না? লইট্টা মাছের সুটকি, ঘইনা মাছের সুটকি, চ্যাপা শুঁটকি।
ওপাশের লোকটি বলল, আপনি স্যার কোথায় ফোন করেছেন?
মনজু একটু থমকাল। এটা কি হোয়াইট হাউজ হোটেলের কিচেন?
জ্বী।
তাহলে তো ভুল জায়গায় ফোন করিনি।
কিন্তু আমি আপনার কথা স্যার বুঝতে পারিনি। কী সব চ্যাপা ফ্যাপা বলছেন। আমি তো এই ধরনের নামই কখনও শুনিনি।
কী? নাম শোনেননি? আপনি কি ভাই আজারবাইজানে থাকেন, না বাংলাদেশে?
লোকটি গম্ভীর গলায় বলল, বাংলাদেশেই থাকি।
মনজু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আর আমার জন্য আমেরিকায়। এই প্রথম বাংলাদেশে এসেছি। তারপরও মিনিমাম তিন প্রকারের সুটকির নাম জানি।
এবার লোকটা যেন একটু লজ্জা পেল। জ্বী স্যার, জ্বী।
মনজু গম্ভীর গলায় বলল, এই হোটেলে সুটকি সার্ভ করে না?
না।
ও। এত লাটবেলাটের হোটেলে তো আমি তাহলে থাকব না। বাংলাদেশে এসেছি, বাঙালি খাবার যখন যা ইচ্ছে খাব। না পেলে অন্য জায়গায় চলে যাব। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।
একটু থামল মনজু। রিসেপসনে ফোন করে বিল পাঠাতে বলুন আর সোনারগাঁও হোটেলে সিঙ্গেল দুটো বেডের একটা রুম বুক করতে বলুন। আপনাদের এখানে আমি থাকব না। এক্ষুনি চলে যাব।
ও পাশের লোকটি বলল, আপনি স্যার রাগ করবেন না।
জ্বী?
আইয়্যাম সরি স্যার।
হ্যাঁ, অত্যন্ত বিনীতভাবে বলুন, সরি স্যার। বলেছেন? ওকে। সুটকি এরেঞ্জ করুন।
বলে বেশ শব্দ করে ফোন নামিয়ে রাখল মনজু।
.
০৮.
রাতেরবেলা পারুর হঠাৎ মনে হলো বাড়ির দলিলপত্রগুলো একটু বের করা দরকার। কী জানি কখন কোন প্রয়োজন হয়! জরুরি কাগজপত্র হাতের কাছে রাখা ভাল।
অবশ্য সবকিছু হাতের কাছেই রেখেছেন মাসুদ সাহেব। এইসব ব্যাপারে তিনি খুবই গোছালো স্বভাবের ছিলেন। টেলিফোন বিলের আলাদা ফাঁইল, সিটি করপোরেশানের ট্যাক্সের আলাদা ফাঁইল। গ্যাস পানি ইলেকট্রিসিটি এসবের আলাদা আলাদা ফাঁইল। সুমি অমি পারু এবং নিজের জন্যও আলাদা ফাঁইল ছিল, ফাঁইলের ওপর নাম এবং বিষয় লেখা। যার যত প্রেসক্রিপশান আছে, রক্ত মল মূত্র ইত্যাদি যতবার পরীক্ষা করা হয়েছে, সে সবের প্রতিটি রিপোর্ট অত্যন্ত যত্নে ফাঁইল করা। এমন কি এই বাড়ি তৈরি করার সময় প্রতিদিন কোন খাতে কত খরচ হয়েছে, কী কী কেনা হয়েছে, ক্যাসমেমোসহ সব ফাঁইল করে রেখেছেন তিনি। বইয়ের দোকানের ব্যাপারেও ছিল একই ব্যবস্থা।