কিয়ের ক্ষতি? না আমার কোনও ক্ষতি হইতাছেনা তো! আপনেগো আমার ভাল লাগে এর লেইগা আমি এই বাড়ি ছাইড়া যাইতে চাই না। মানুষের ভাল লাগার একটা দাম আছে না!
কিসের ভাললাগা? আমাদের বাড়ি ভাল লাগার কি কোনও কারণ। আছে? বাড়ির খাওয়া ধাওয়া ভাল না, একদিন বাজার হবে একদিন হবে না! এরকম বাড়িতে তুমি কেন থাকবে, বল?
পারুর কাছে সামান্য এগিয়ে এসে শিরিন বলল, সাফ কথা শোনেন আম্মা। আপনেরা খাইলে আমি খামু, আপনেরা না খাইলে আমি খামু না। আর আপনে এত ভাইঙ্গা পড়ছেন ক্যান? বিপদে পড়া ভাল মানুষের জন্য আল্লাহপাকের দরবার থিকা ফেরেশতা নাইমা আসে। আইসা বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ায়। আপনেগ পাশেও দাঁড়াইবো। ডরায়েন না। ভাল মানুষের লেইগা আল্লাহ আছে।
শিরিন যে মুহূর্তে এসব কথা বলছে ঠিক তখুনি ঢাকার জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এসে নামল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি বিমান।
.
০৬.
নিজের রুম থেকে বেরিয়েই মার মুখোমুখি পড়ে গেল অমি।
কিচেন থেকে বেরিয়েছেন পারু। অমিকে দেখে দাঁড়ালেন। কোথায় যাচ্ছিস?
বাইরে।
বাইরে কোথায়?
অমি একপলক মায়ের মুখের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নীচু করল। তেমন কোথাও না।
পারু অবাক হলেন। মানে?
আবার চোখ তুলে মায়ের মুখের দিকে তাকাল অমি। মা, বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন, কখনও যেন কারও সঙ্গে মিথ্যে কথা না বলি। মিথ্যে বলার অবস্থা হলে কথাটা আমি এড়িয়ে যাই।
এড়াবার দরকার নেই। সত্য কথা বল।
কম্পিউটারের কাজ নিতে চাইলাম, তুমি রাজি হলে না। এজন্য আমি টিউশনি খুঁজছি। দুটো টিউশনি পেলে বারো থেকে পনেরোশো টাকা। দু জায়গায় দুঘণ্টা পড়াব। ভালমতো খুঁজলে টিউশনি আমি পেয়ে যাব। নিজের পড়াশুনোরও কোনও অসুবিধা হবে না। আজকাল অনেকেই টিউশনি করে।
পারু নির্বিকার গলায় বললেন, তুইও করিস। তবে পরীক্ষার পর।
এখন অসুবিধা কী?
এখন টিউশনি করলে পড়াশুনোর ক্ষতি হবে। এখন যে কয়েকটা মাস আছে ঘরে বসে ভাল মতো পড়াশুনো কর যাতে রেজাল্ট খুব ভাল হয়।
অমি চুপ করে রইল।
পারু বললেন, যা ঘরে যা।
আবার মায়ের মুখের দিকে তাকাল অমি। কিন্তু মা, সংসারের এই অবস্থা …..।
অমির কথা শেষ হওয়ার আগেই পারু বললেন, ওসব তোকে ভাবতে হবে না। ভাবব আমি।
অমি আর কথা বলল না। নিজের রুমে গিয়ে ঢুকল।
তারপরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন পারু। একটা দীর্ঘশ্বাসও পড়ল তাঁর।
ঠিক এরকম একটি দীর্ঘশ্বাস মনজুরও পড়ল।
খানিক আগে ইমিগ্রেশান ইত্যাদির ঝামেলা শেষ হয়েছে। হ্যাঁন্ডব্যাগ নিয়ে লাগেজ আসার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে মনজু।
লাগেজ আসতে শুরু করেছে বেশ খানিক আগে। কিন্তু মনজুরটা এখনও আসেনি।
একটি মাত্র সুটকেস তার। আর সঙ্গে একটা ব্যাগ। এই নিয়ে চলে এসেছে।
মনজুর পরনে জিন্স। পায়ে বুট। চুলগুলো বিদেশীদের ভঙ্গিতে ছাটা। মুখখানি খুব মায়াবি তার। এই মায়াবি মুখ প্লেন জার্নিতে ক্লান্ত। তবু ক্লান্তিটা মনজু টের পাচ্ছে না। বুকে তার অদ্ভুত এক উত্তেজনা।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে কোন হোটেলে যাবে মনজু?
মনজু যখন একথা ভাবছে ঠিক তখুনি তার সুটকেসটা বেরিয়ে এল। একটু এগিয়ে গিয়ে সুটকেসটা মনজু নামাল। তারপর একহাতে ব্যাগ, অন্যহাতে সুটকেস টানতে টানতে গ্রীন চ্যানেলের দিকে হাঁটতে লাগল। দীর্ঘশ্বাসটা তখনই পড়ল তার।
কেন?
মনজুর কি মনে হলো জীবনে প্রথম নিজের দেশে ফিরল সে কিন্তু কেউ তাকে রিসিভ করতে এল না!
ইমিগ্রেশান এরিয়ার বাইরে বড় বড় সব হোটেলের কাউন্টার। যে কোনও একটা কাউন্টারে গিয়ে যে কোনও হোটেলে রুম বুক করতে পারে মনজু। হোটেল কাউন্টার থেকে গাড়িও ব্যবস্থা করে দেবে।
কিন্তু মনজু তা করল না। ব্যাগ সুটকেস নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।
বাইরে প্রচুর স্কুটার, ইয়েলোক্যাব। ড্রাইভাররা ডাকাডাকিও শুরু করল। এইসব গাড়ির সঙ্গে দালালও থাকে। দুচারজন দালালও লাগল মনজুর পেছনে। কিন্তু সে কাউকে পাত্তা দিল না, কারও দিকে ফিরে তাকাল না। একটি ইয়েলোক্যাবের সামনে তার বয়সী, ভদ্রগোছের এক যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়িটা আপনার?
জ্বী!
যাবেন?
কোথায়?
কোনও একটা হোটেলে।
কী ধরনের হোটেল? সোনারগাঁও, শেরাটন! নাকি পূবাণী?
এগুলো তো বড় হোটেল?
জী।
আমি যেতে চাইছি মাঝারি ধরনের কোনও একটা হোটেলে। আপনার চেনা তেমন কোনও হোটেল আছে?
জ্বী আছে।
কোথায়?
শান্তিনগরে।
কী নাম?
হোয়াইট হাউজ।
সুন্দর নাম।
হোটেলটাও সুন্দর।
ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধমুখে হাসল মনজু। আপনি বলছেন?
ড্রাইভারও হাসল। জ্বী স্যার।
চলুন তাহলে।
সুটকেসটা কেরিয়ারে তুলল ড্রাইভার। হ্যাঁন্ডব্যাগটা সঙ্গে রাখল মনজু। গাড়ি ছুটতে লাগল।
কিন্তু কী আশ্চর্য ব্যাপার, গাড়িতে চড়েই মনজুর খুব ইচ্ছে করল এককাপ চা খেতে। এসময় আচমকা কেন চায়ের তেষ্টা পেল তার, কে জানে!
তবে একই সঙ্গে একই ধরনের কাজ প্রায়ই ঘটে পৃথিবীতে। ইয়েলোক্যাবে বসে মনজুর যখন চায়ের তেষ্টা পাচ্ছে পারু তখন এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসেছেন।
বারান্দায় উদাস হয়ে বসে আছে সুমি। চা হাতে পারু তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। নে।
সুমি খুবই অবাক হলো। হঠাৎ চা?
এ সময় মাঝে মাঝে চা খেতেন তোর বাবা। আমার হাতের চা। আজ মনে হলো ওরকম এককাপ চা আমি তোর জন্য করি।