অমির কথা শুনতে শুনতে জলে চোখ ভরে এলো পারু। দুহাতে ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন তিনি। মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ভাঙাচোরা গলায় বললেন, কী কপাল আমার! এইটুকু ছেলেকে রোজগারের কথা ভাবতে হচ্ছে। না না, তুই এসব ভাবিস না বাবা। তুই এসব ভাবিস না। তুই মন দিয়ে পড়াশুনো কর। পরীক্ষা দে। আমি তো বেঁচে আছি। যা করার আমি করব।
মায়ের বুকে অমি তখন নিঃশব্দে কাঁদছে।
বাইরে থেকে ফিরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল সুমি, মায়ের রুমের দিকে চোখ পড়তেই এই দৃশ্যটা দেখতে পেল। নিজের রুমে আর গেল না সে। মায়ের রুমে এসে ঢুকল। কী হয়েছে?
পারু বললেন, কিছু না।
তারপর বুক থেকে আলগা করলেন অমিকে। যা, হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস গিয়ে, যা।
অমি কোনওদিকে তাকাল না। চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল।
এবার সুমির দিকে তাকালেন পারু। তুই হঠাৎ কোথায় চলে গেলি? আমাকে কিছু বলেও গেলি না।
সুমি কেমন চটপটে হয়ে গেল। আমার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম।
কেন?
ওই যে তুমি বললে ঘরে কোনও টাকা পয়সা নেই।
পারু অবাক হলেন। ধার আনতে গেলি?
সুমি আগের মতোই চটপটে গলায় বলল, না মানে ও আমাকে ফোন করল তো, কথায় কথায় বললাম, তোর কাছে কিছু টাকা হবে?
বান্ধবীর নাম কী?
ওকে তুমি চিনবে না। আমাদের বাড়িতে কখনও আসেনি।
পারু গম্ভীর গলায় বললেন, নাম কী?
টিংকু, টিংকু। কথায় কথায় বললাম তোর কাছে হাজার পাঁচেক টাকা হলে আমাকে দে। পাঁচ হাজার হয়নি। সাড়ে চার হাজার হয়েছে। তাই দিয়ে দিল।
হাতের ব্যাগ খুলে টাকাটা বের করল সুমি। পারুর হাতে দিল। বুয়ার বেতনটা দিয়ে দাও, আর বাজার টাজার….।
টাকা হাতে নিয়ে পারু বললেন, ফেরত দিতে হবে কবে?
যখন ইচ্ছে দিলেই হবে। কোনও তাড়া নেই।
টাকা হাতে আলমারির দিকে মুখ ফিরিয়েছেন পারু, হঠাৎ যেন তার মনে হলো সুমির গলাটা ফাঁকা ফাঁকা। চেনটা নেই। সঙ্গে সঙ্গে সুমির গলার দিকে তাকালেন তিনি।
সত্যি তো! চেনটা তো নেই।
বললেন, তোর চেন কোথায়?
সুমি একটু চমকাল। গলার কাছটায় হাত দিল। আছে।
পরে যাসনি?
না। মানে খুলে রেখে গেছি।
কেন?
যা ছিনতাই টিনতাই হয় রাস্তায়!
পারু গম্ভীর হলেন। কোথায় রেখেছিস চেন? যা নিয়ে আয়।
কেন?
আমি দেখব।
তুমি হঠাৎ আমার চেন নিয়ে পড়লে কেন? আছে আমার রুমে। পরে দেখাব তোমাকে।
পারুর মুখটা করুণ হলো। কেন অযথা মিথ্যে বলছিস?
মিথ্যে বলছি মানে?
যা বোঝার আমি বুঝে গেছি।
সুমি জোর গলায় বলল, কী বুঝে গেছ তুমি? কী?
চেন বিক্রি করে এই টাকাটা তুই এনেছিস।
সঙ্গে সঙ্গে উদাস হয়ে গেল সুমি। হ্যাঁ, এছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই করার ছিল না মা।
পারুর চোখ আবার জলে ভরে এলো।
মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর কাঁধে হাত দিল সুমি। সুমি এত মন খারাপ করছ কেন? টাকা হলে চেন আবার কিনে নেয়া যাবে। প্রয়োজনে এই সমস্ত জিনিস সবাই বিক্রি করে।
পারু চোখ মুছে বললেন, এরপর কী বিক্রি করবি?
মায়ের কাঁধ থেতে হাত নামিয়ে সুমি চঞ্চল গলায় বলল, এখন ওসব ভেবে লাভ নেই। আমার খুব খিদে পেয়েছি। বুয়াকে বল খাবার রেডি করতে।
সুমি নিজের রুমের দিকে চলে গেল।
.
০৫.
আজ সকালে শিরিন নিজে বাজার করেছে।
শাক সবজি মাছ মশলা, মনখানেক চাল, মাসখানেক চলার মতো আটা অর্থাৎ যা যা লাগে সংসারে। এখন ব্যস্ত হাতে সেসব গুছিয়ে গুছিয়ে রাখছে। কোনওদিকে খেয়াল নেই তার। পারু এসে যে দরজার সামনে দাঁড়ালেন, তাঁর ডানহাতে যে মুঠো করে ধরা কিছু টাকা, শিরিন তা খেয়ালই করল না।
কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে শিরিনকে খানিক দেখলেন পারু, তারপর ডাকলেন, বুয়া।
চমকে দরজার দিকে তাকাল শিরিন।
মুঠো আলগা করে টাকাটা শিরিনের দিকে এগিয়ে দিলেন পারু। তোমার তিনমাসের বেতন।
টাকার দিকে ফিরেও তাকাল না শিরিন। ব্যস্ত হাতে কাজ করতে করতে বলল, এখন তো কাম করতাছি। রাখেন আপনের কাছে। পরে নিমুনে।
পারু বললেন, কাজ এখন রাখ।
ক্যান?
কথা শোন। কথা আছে।
শিরিন কাজ থামাল। বলেন।
পারু আবার টাকা এগিয়ে দিলেন। এটা রাখ।
আঁচলে হাত মুছে টাকাটা নিল শিরিন, আঁচলেই গিঁট দিয়ে রাখল। রাখতে রাখতে বলল, আইচ্ছা নিলাম। এইবার কন, কী কথা?
এ মাসের তো আর কয়েকটা দিন বাকি আছে, এখন থেকে তুমি কাজ খুঁজতে শুরু কর।
শিরিন চমকাল। জ্বে?
হ্যাঁ, যাতে পহেলা তারিখ থেকে লেগে যেতে পার।
এবার যেন কথাটা পুরো বুঝল শিরিন। বিব্রত গলায় বলল, ক্যান, আপনে কি আমারে ছাড়ায়ে দিলেন নাকি? আমি কি কাম খারাপ করি, আ আমার কোনও বদস্বভাব আছে?
আরে না। কাজ খুবই ভাল কর তুমি। তুমি মানুষও ভাল। তোমার মতো লোক আমি কোথায় পাব। এতদিন ধরে আছ, এত বিশ্বস্ত।
তাইলে আমার অসুবিদা কি?
অসুবিধা তোমার না, আমাদের। তুমি তো সবই জানো। বাড়িতে কাজেরা বুয়া রাখা এখন আর আমার পক্ষে সম্ভব না। মাসে তিনশো টাকা বেতন আমি কোত্থেকে দেব?
শিরিন নির্বিকার গলায় বলল, না দিতে পারলে দিবেন না।
পারু অবাক। তোমার তাহলে চলবে কী করে?
আল্লায় চালায় নিব। এই নয়শো টাকা মার কাছে পাড়াইয়া দিয়া কমু, আর দিতে পারুম না। যেমনে পার আমার পোলারে মানুষ কর, না পারলে এতিমখানায় দিয়া দেও।
শিরিনের কথা শুনে পারুর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। কেন আমাদের জন্য নিজের এত ক্ষতি তুমি করবে?