পারু কাতর গলায় বললেন, আমি সব জানি। আর কয়েকটা দিন দেরি কর।
শিরিন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। জ্বে আইচ্ছা, হেইডা করুমনে। আপনের অসুবিদাঁড়া আমি বুজি আম্মা। সাহেব আঁথকা মইরা গেলেন, অসুবিদা তো একটু হইবই। আপনেগ তো আর কোনও রুজি রোজগারের মানুষ নাই। তয় টেকার লগে কয়েকটা দিনের ছুট্টিও আমারে দিয়েন। পোলাডারে একটু দেইখা আসুমনে।
শিরিন আর দাঁড়াল না।
শিরিন চলে যাওয়ার পর খানিক কী ভাবল পারু তারপর সুমির রুমে এসে ঢুকল।
জানালার কাছে পুরনো বেতের চেয়ার নিয়ে বসে আছে সুমি। কোলের ওপর মলাট ঝুলে পড়া, খুবই জীর্ণ একটা অ্যালবাম। সেই অ্যালবাম ঘেঁটে বাবার সঙ্গে তার এবং অমির ছবি দেখছে। মার সঙ্গে বাবার ছবি দেখছে।
খুব বেশি ছবি নেই তাদের। তবু যা দুচারটা আছে সেইসব ছবি ঘিরে কত আনন্দ বেদনার স্মৃতি।
কোনও কোনও ছবি দেখে চোখ ছলছল করছিল সুমির।
পারু এসব খেয়াল করলেন না। অসহায় গলায় বললেন, কী করি এখন বল তো?
সুমি চোখ তুলে তাকাল। কী হয়েছে?
ঘরে টাকা পয়সা কিছু নেই। বাজার করার টাকাটা পর্যন্ত নেই।
সুমি উঠে দাঁড়াল। অ্যালবামটা বিছানার ওপর রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাবার মৃত্যুর দিনই বুঝেছিলাম, দশ পনের দিন পরই এই অবস্থা হবে আমাদের। যেখানে যা কিছু ছিল নার্সিংহোমেই তো গেছে।
তারপরও প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই …..।
পারুর কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি বলল, এরচে’ বেশি কিছু আমাদের করার ছিল না মা। সিভিয়ার হার্টএ্যাটাক।
তবু টাকা পয়সা থাকলে, বিদেশে নিয়ে যেতে পারলে ….।
এবারও তার কথা শেষ করতে দিল না সুমি। বলল, এসব এখন আর ভেব না। এখন ভাব অন্য সমস্যার কথা।
ভেবে কী করব বল! পাশে দাঁড়াবার মতো একজন মানুষ নেই, যে কিছুটা সাহায্য করবে, পরামর্শ দেবে।
সুমি আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্যি কী দুর্ভাগা আমরা। একজুন মাত্র মাঝারি ধরনের বড়লোক আত্মীয় আছে, বাদলভাই, পুরো ফ্যামিলি নিয়ে তিনি ইমিগ্রান্ট হয়ে গেছেন কানাডায়। আর যা দুচারজন আত্মীয় স্বজন আছে তাদের অবস্থা আমাদের চেয়েও খারাপ। তোমার। দিককারও, বাবার দিককারও। ওরা আমাদেরকে কী সাহায্য করবে, চিরকাল বাবার কাছেই সাহায্যের জন্য আসা যাওয়া করেছে।
এসব কথা ভাল লাগছিল না পারুর।
অধৈর্যের গলায় তিনি বললেন, কিন্তু এখন কী করব? বুয়ার তিনমাসের বেতন বাকি, মাসের প্রথম দিক এখন, কত রকমের বিল দিতে হবে। টেলিফোন বিল, ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস, পানি। মাসের বাজার। সুমি, এইসব টেনশানে তোর বাবার কথাও আমি ভাবতে পারছি না।
মার অস্থিরতা দেখে তার একটা হাত ধরল সুমি। তুমি এত নার্ভাস হয়ো না মা। ব্যবস্থা কিছু না কিছু একটা হবেই।
কী ব্যবস্থা হবে? আমি তো কোনও পথ দেখছি না।
তারপর হঠাৎ করেই যেন মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল তার। টেলিফোনটা বিক্রি করে দিই?
সুমি অবাক হলো। মানে?
তোর বাবার অসুখের সময় পাশের বাড়ির মিতুর মা আমাকে বলেছিল, টাকা পয়সার খুব দরকার হলে আমাদের টেলিফোনটা তারা কিনতে পারে। আমাদের ফোনটা পেলে ওদের সুবিধা হলো ট্রান্সফার করার টাকা বেঁচে যায়।
সুমি চিন্তিত হলো। কিন্তু বাড়িতে একটা ফোন থাকবে না?
ফোন দিয়ে এখন আর আমরা কী করব বল? কাকে ফোন করব, কে আমাদেরকে ফোন করবে?
বাবা অনেক কষ্ট করে ফোনটা এনেছিল। বাবার নামে ফোন।
তাতো আমি জানিই। উপায় না দেখেই ভাবছি। নয়তো ঘরের জিনিস কে বিক্রি করতে চায়, বল?
দুচারটা দিন যাক। আর একটু ভেবে …..।
সুমির কথা শেষ হওয়ার আগে মা ভেঙেপড়া গলায় বললেন, এই দুচারদিই বা চলবো কী করে? সামান্য গয়নাগাটি যা ছিল আমার, সব তো আগেই গেছে। তোদের নিয়ে এখন আমার না খেয়ে মরতে হবে।
পারু ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
তারপর চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।
মা বেরিয়ে যাওয়ার পর উদাস হয়ে খানিক কী ভাবল সুমি, তারপর গলার চেনটা আলতো করে ধরল।
.
০৪.
টেলিফোন বিলগুলো খুবই যত্নে একটি ক্লিপ ফাঁইলে রেখে দিয়েছেন মাসুদ সাহেব। যখনই বিল আসতো, বিল পরিশোধ করার পর কাউন্টার পার্ট রেখে দিতেন ফাঁইলে। সেই ফাঁইলটা নিয়ে আজ দুপুরের পর বসেছেন পারু। একটা একটা করে বিল চেক করছেন, কোনও মাসের বিল বাকি পড়েছে কিনা দেখছেন।
টেলিফোনটা বিক্রি করতে হলে বিল ক্লিয়ার থাকতে হবে।
এসময় বিষণ্ণমুখে অমি এসে ঢুকল এই রুমে। ফোনটা সত্যি বিক্রি করে ফেলবে মা?
মুহূর্তের জন্য ছেলের দিকে তাকালেন পারু। এছাড়া কী করব, বল?
তারচে’ না হয় আমার কম্পিউটারটা …..। মানে কম্পিউটার তো আমাদের তেমন দরকার নেই। কম্পিউটারের চেয়ে টেলিফোন বেশি। দরকারি।
ফাঁইল রেখে উঠে দাঁড়ালেন পারু। তোর অত শখের জিনিস। কত কষ্ট করে তোর বাবা কিনে দিয়েছিলেন! তাছাড়া পুরনো কম্পিউটার সেভাবে বিক্রিও করা যায় না। আর ফোনের ব্যাপারটা হলো, তোর বাবাই যখন নেই, ফোন দিয়ে আমরা আর কী করব?
অমি আমতা গলায় বলল, আর একটা কথা বলব?
বল।
তুমি রাগ করবে না তো?
না।
কম্পিউটার টাইপিংটা আমি খুব ভাল শিখেছি। বেশ ভাল স্পিড আমার। ইচ্ছে করলে যে কোনও জায়গায় কাজ পাব আমি। কোনও পত্রিকা অফিসে, কিংবা কোনও প্রেসে।
কিন্তু মাস চারেক পর তোর পরীক্ষা।
পার্টটাইম কাজ নেব। ওই কাজ করেও পরীক্ষা দেয়া যাবে। কোনও অসুবিধা হবে না। দেড় দুহাজার টাকা আমি রোজগার করতে পারব।