মির্জা সাহেবের মুখটা থমথম করছে।
বাইরে থেকে এসেই সাধারণত গায়ের পাঞ্জাবিটা খোলেন তিনি। এখন খুললেন না। গম্ভীর মুখে পালঙ্কে বসলেন।
বকুল বললেন, কী হলো? কথা বলছ না কেন?
কী বলব?
কী বললেন চেয়ারম্যান সাহেব?
মির্জা সাহেব কথা বললেন না।
স্বামীর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন না বকুল। তার পাশে বসলেন। কী হয়েছে?
কিছু না।
কিছু না হলে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
এবার রাগে ফেটে পড়লেন মির্জা সাহেব। বদমাসটাকে চেয়ারম্যান বানিয়ে ছিলাম আমি। আমি না বললে গ্রামের লোকে ওকে ভোট দিত না। সেই ব্যাটা আজ আমাকে শাসায়?
শাসায় মানে? কী বলেছে?
আমাকে বলে ওদের সঙ্গে দালালের খাতায় নাম লেখাতে।
মানে?
মানে পিস কমিটির মেম্বার হতে বলে আমাকে। কী মনে করেছে ও আমাকে? ছেলেকে মুক্তিবাহিনীতে যেতে দিইনি বলে আমি কি দেশের স্বাধীনতা চাই না? আমি কি ওদের মতো পাকিস্তানি কুকুর?
উঠোন দিয়ে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল বাদল।
মির্জা সাহেবের গলা শুনে নিজের ঘরে না গিয়ে মা বাবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।
বাদলকে খেয়াল করলেন না মির্জা সাহেব, স্ত্রীকে বললেন, বাদলের মা, তোমার ছেলেকে বলে দাও, বিয়েসাদি বাদ। সে যা চায় তাই করুক। মুক্তিবাহিনীতে চলে যাক।
বাবার মুখে একথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না বাদল। ঘরে ঢুকে গেল। বাবা।
বাদলকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন মির্জা সাহেব। আদেশের গলায় বললেন, কাল সকালেই চলে যাবি। দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না।
বাদল দৃঢ় গলায় বলল, অবশ্যই।
তবে ফিরে এসে একটি দালালকেও ছাড়বি না। দেশের জন্য দরকার হলে শহীদ হয়ে যাবি।
বাবার কথায় এতটাই আপুত হল বাদল, বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।
.
২৬.
বাদল ভেবেছিল চলে যাওয়ার সময় যমুনার সঙ্গে তার দেখা হবে না। কারণ এত সকালে তার ওঠার কথা না।
কিন্তু সকাল সকাল রওনা না দিয়ে বাদলের উপায়ও নেই।
মা বাবা ও খুকির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাঠের দিকটায় এসেছে বাদল, খড়ের গাদার ওদিকটায় ঠিক দাঁড়িয়ে আছে যমুনা। ঘুম ভাঙা মুখখানি তার আনন্দে তখন ফেটে পড়ছে।
বাদলকে দেখেই এগিয়ে এল সে।
বাদল বলল, তুমি কখন এখানে এলে?
আপনি যখন মামা মামীর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন তখনই।
ভাল করেছ। তোমাকে দেখে খুব ভাল লাগছে।
আমারও খুব ভাল লাগছে। আপনি স্বাধীনতা যুদ্ধে যাচ্ছেন আর আমি আপনাকে বিদায় জানাচ্ছি, এটা সত্যি অসম্ভব আনন্দের।
শুনে বাদল খুবই আপুত হল। তোমাকে একটা কথা বলব?
হ্যাঁ।
যাওয়ার আগে তুমি যদি আমাকে একবার তুমি করে বলতে, আমার খুব ভাল লাগত।
বাদলের কথা শুনে অপলক চোখে তার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল যমুনা, তারপর দুহাতে বাদলের একটা হাত জড়িয়ে ধরল। এই যে তোমার হাত ধরলাম, জীবনে এই হাত কখনও ছাড়ব না।
বাদলও ধরল যমুনার হাত। সত্যি?
এরচে’ বড়সত্য আর কিছু নেই আমার জীবনে। যেখানেই থাক তুমি, জানবে, আমি তোমার সঙ্গে আছি। তোমার হাত ধরে আছি।
আবেগে গলা বুজে এল বাদলের। সে আর কোনও কথা বলতে পারল না।
.
২৭.
খানিকটা বেলা হওয়ার পর মাঠপারের দিকে গিয়েছিল মির্জা বাড়ির গোমস্তা নবু, গিয়ে দেখে দূরের রাস্তা দিয়ে সারধরে মিলিটারি আসছে বনসীমান্তের দিকে। তাদের সঙ্গে একজন চেনা লোককে দেখতে পেল নবু। জলিল রাজাকার। সে আছে তাদের আগে আগে। যেন পথ দেখিয়ে আনছে মিলিটারিদেরকে।
মুহূর্তখানেক দৃশ্যটা দেখল নবু, তারপর চিৎকার করতে করতে মির্জা বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল। মেলেটারি আসতাছে, মেলেটারি আসতাছে।
মুহূর্তে পুরো বনসীমান্ত জেনে গেল কী ঘটতে যাচ্ছে। যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল ছুটতে শুরু করল।
মির্জা বাড়িতেও হুলস্থুল পড়ল।
ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যমুনা বলল, কী? মিলিটারি আসছে?
শিরিন বললেন, সর্বনাশ! এখন কী হবে?
বরকত বলল, যে ভয়ে ঢাকা থেকে পালালাম সেই ভয় তো এখানেও!
বকুল বললেন, বাড়ির লোকজন নিয়ে এখন কোথায় যাব আমরা?
মাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপতে লাগল খুকি। আমার ভয় করছে। মা।
মির্জা সাহেব ছিলেন কাছারি ঘরে, হৈ চৈ শুনে ছুটে বেরুলেন। কী হয়েছে এ্যাঁ, কী হয়েছে?
নবু হাপাতে হাপাতে বলল, মেলেটারি আসতাছে। আমি নিজ চোখে দেখছি। লগে জলিল রাজাকার।
তার মানে জলিল মিলিটারিদের জানিয়েছে বনসীমান্তে জয় বাংলার ট্রেনিং হচ্ছে। এজন্য মিলিটারিরা এখন গ্রাম জ্বালাতে আসছে। যাকে পাবে তাকেই এখন গুলি করে মারবে।
নবু বলল, তাই তো মনে হইতাছে।
সর্বনাশ! তাহলে এক্ষুনি সবাইকে নিয়ে পালাতে হবে। নবু, তুই একটা কাজ কর, গোয়ালের গরুগুলো সব ছেড়ে দে। যেদিকে ইচ্ছে চলে যাক।
নবু গোয়ালের দিকে ছুট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম গুলির শব্দটা হলো।
.
২৮.
বিলু ঘুমিয়ে ছিল জলধর ডাক্তারের ঘরে।
গুলির শব্দে তার ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল সে। ছুটে ঘর থেকে বেরুল।
পুরো বনসীমান্ত জুড়ে তখন মানুষের পায়ের শব্দ। ছুটোছুটি, ভয় চিৎকার আতঙ্ক। গুলির শব্দ হচ্ছে অবিরাম। গাছের পাখিরা সব আকাশে উড়াল দিয়েছে। কাকগুলো সব কা কা করছে।
মুহূর্তকাল কী ভাবল বিলু তারপর স্কুলমাঠের দিকে দৌড় দিল। অন্য কিছুই আর তার মনে নেই, শুধু মনে আছে স্কুলমাঠের লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁধা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার কথা। যেমন করেই হোক পতাকাটা তাকে রক্ষা করতে হবে।