.
২৩.
জলধর ডাক্তার মাধবিকে নিয়ে যে ঘরটায় থাকতেন সেই ঘরের দরজায় এখন বেশ বড় একটা তালা ঝুলছে। নির্জন বাড়িটিকে যেন আরও নির্জন করে তুলেছে ওই তালাটা।
বাড়ি ঢুকে এই তালাটাই প্রথমে চোখে পড়ল জলিলের।
জলিলের সঙ্গে আছে তার সারাক্ষণের সঙ্গী তালেব। আর জনা চারেক কামলা মজুর ধরনের লোক।
রাজাকার হওয়ার পর জলিলের চেহারায় চেকনাই অনেক বেড়ে গেছে। গলার সুর গেছে বদলে। এখন আর কোনও ব্যাপারে কাউকে অনুরোধ করে না জলিল। আদেশ করে।
এখনও করল। তালেব, তালাটা ভাঙ।
তালেব বলল, তারপর?
তালা ভাইঙ্গা ঘর থিকা ডাক্তারের চেয়ারটা বাইর কর।
করে?
আমারে দে। আমি ঐ চেয়ার নিয়া উঠানে বসব।
তারপর?
তারপর আর কিছু না। আইজ থিকা এই বাড়িটা আমার। আগে এই বাড়িরে লোকে বলত জলধর ডাক্তারের বাড়ি, আইজ থিকা বলব জলিল রাজাকারের বাড়ি।
সঙ্গে সঙ্গে শরীরের তাক যেন বেড়ে গেল তালেবের। একজন মজুরের হাত থেকে সাবল নিয়ে জলধর ডাক্তারের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে।
ঠিক তখুনি এই বাড়ির দিকে আসছিল বিলু।
গাছপালার আড়াল থেকে দেখতে পেল উঠোনে জলিলরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে, আর জলধর ডাক্তারের ঘরের তালা ভাঙছে তালেব।
বিলু আর দেরি করল না। স্কুল মাঠের দিকে দৌড় দিল।
স্কুল মাঠের পতাকাতলে দাঁড়িয়ে ছিল বাদল এনামুল আর আলমগির। বাদলের হাতে মির্জা সাহেবের বন্দুক।
এনামুলকে বাদল বলল, আমি আর দেরি করতে চাই না এনামুল ভাই।
এনামুল বলল, কেন?
অসুবিধা আছে।
কী অসুবিধা?
পারিবারিক। আপনাকে বলতে চাচ্ছি না। আমাকে আর আলমগিরকে আপনি একসঙ্গে পাঠিয়ে দিন।
এনামুল চিন্তিত গলায় বলল, আমাকেও তোমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
আলমগির বলল, কেন? গ্রামে আর থাকা যাবে না।
তখুনি পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এল বিলু। আপনেরা তাড়াতাড়ি আসেন। ডাক্তারকাকার বাড়ি দখল করতাছে জলিল মিয়ারা।
শুনে বাদল একটা লাফ দিল। কী?
তারপর বন্দুক হাতে জলধর ডাক্তারের বাড়ির দিকে ছুটল। তার সঙ্গে সঙ্গে ছুটল আলমগির আর বিলু।
কিন্তু এনামুল তেমন জোরে ছুটতে পারছিল না। ক্রাচে ভর দিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব ছুটছিল সে।
ওরা যখন জলধর ডাক্তারের বাড়ি এল, ততোক্ষণে ঘরের তালা ভাঙা হয়ে গেছে। জলধরের হাতাঅলা চেয়ারটা বাইরে, উঠোনে এনে রাখা হয়েছে। সেই চেয়ারে বেশ একখানা ভাব ধরে বসেছে জলিল। একজন কামলা তাকে তালপাখায় বাতাস করছে।
জলিল তাকে বলল, জোরে বাতাস কর। আরও জোরে। আইজ কাইল আমার একটু বেশি গরম লাগে।
বাদল গম্ভীর গলায় বলল, কী করছেন এখানে?
বাদলকে বন্দুক হাতে দেখে আর তার জলদ গম্ভীর গলা শুনে ভয় পেয়ে গেল জলিল। তড়াক করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল সে। কিছু করি না, কিছু করি না।
ঘরের তালা ভেঙেছে কে?
আমি না, আমি না। তালেব।
ভয়ে তালেবেরও ততোক্ষণে মুখ শুকিয়ে গেছে। ঢোক গিলে সে বলল, আমার দোষ নাই। জলিল আমারে ভাঙতে কইছে।
যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। আমার উচিত আপনাদের দুজনকেই গুলি করা। এটা আপনাদের প্রথম অন্যায় বলে গুলিটা আমি করব না। বেরোন, বেরোন বাড়ি থেকে।
জলিল বলল, হ হ যাইতাছি গা।
তারপর তালেবের দিকে তাকাল। তালেব, ল।
লও।
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর এনামুল বলল, জলিলের এই যাওয়া কিন্তু শেষ যাওয়া নয় বাদল।
তাহলে?
জলিল হচ্ছে গোখরো সাপ। গোখরো সাপ ব্যথা পেয়ে পালিয়ে যায় ঠিকই কিন্তু আড়াল থেকে শত্রুকে ফলো করে। সুযোগ পেলেই ছোবলটা দেয়।
আলমগির বলল, তার মানে জলিলও ছোবল দেবে?
অবশ্যই।
ঠিক এই কথাটাই জলধর ডাক্তারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলল জলিল। ছোবল না, আমি দিমু কামড়। কামড় দিয়া খাইয়া ফালামু।
তালেব বলল, তোমার কথা বুঝলাম না।
রাজাকারে নাম লেখাইছি। কাইলই থানায় গিয়া মেলেটারি সাহেবগ জানামু আমগ বনসীমান্ত গ্রামে মুক্তিবাহিনীর টেরনিং হইতাছে। কমান্ডার হইল বাদল। দেখবি আর কিছু লাগব না। ডাক্তারের বাড়ি তো আমি দখল করুমই, মির্জা বাড়িও করুম।
জলিলের কথা শুনে খুবই আমোদ পেল তালেব। খি খি করে হাসতে লাগল সে।
.
২৪.
বিকেলবেলা মাঠের দিক থেকে হেঁটে আসছে বাদল।
বাড়ি ঢুকবে। নাড়ার পালাগুলোর ওদিক থেকে বেরিয়ে এল যমুনা।
যমুনাকে দেখে থমকে দাঁড়াল বাদল। তুমি এখানে?
যমুনা সরল গলায় বলল, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।
কেন?
আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
বাদল মাথা নীচু করল। আমি জানি তুমি কী বলবে।
যমুনা বলল, না আপনি জানেন না।
বাদল একটু চমকাল। যমুনার দিকে তাকাল। মানে?
বাদলের চোখের দিকে তাকিয়ে যমুনা বলল, আমি চাই বিয়েটা হোক।
কী?
হ্যাঁ।
কী বলছ তুমি?
আমি আমার মনের কথা বলছি। তবে তারপরও কথা আছে।
সে কথা আর বাকি রাখছ কেন? বলে ফেল।
যমুনা মিষ্টি করে হাসল। কথা না শুনেই রেগে যাওয়া ঠিক না।
আমি রেগে যাইনি।
তাহলে?
অবাক হয়েছি।
অবাক হওয়ারও কিছু নেই। কারণ …….।
কারণ?
বিয়েটা হবে স্বাধীনতার পর।
সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভার নেমে গেল বাদলের। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল। সত্যি?
যমুনা মিষ্টি করে হাসল। সত্যি। যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।
বাদল মুগ্ধ চোখে যমুনার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
২৫.
মির্জা সাহেব আজ ফিরলেন রাত করে।
বকুল একটু উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন। স্বামীকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ব্যস্ত হলেন। চেয়ারম্যান সাহেব খবর পাঠিয়েছিলেন কেন?