খালপারে এসেই মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে লাগল মাধবি।
ততোক্ষণে বাদল এবং আলমগিরও এসেছে খালপারে।
মাধবিকে কাঁদতে দেখে বাদল তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কাঁদছ কেন দিদি?
কথাটা সে বলল ঠিকই, কিন্তু তার চোখ দুটোও ছলছল করতে লাগল। গলা বুজে এল উদগত কান্নায়।
তবু মাধবিকে সে সান্ত্বনা দিতে লাগল। দিদি, দিদি এভাবে কেঁদ না। কেঁদ না। দেশ নিশ্চয় স্বাধীন হয়ে যাবে। নিশ্চয় তোমরা আবার ফিরে আসবে।
আলমগির বলল, স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমানের কোনও ব্যবধান থাকবে না।
জলধরও তখন দুহাতে চোখ মুছছেন।
মাধবিকে রেখে বাদল গিয়ে দাঁড়াল জলধর ডাক্তারের সামনে। আপনিও ছেলেমানুষি করছেন ডাক্তার কাকা?
জলধর নিজেকে সামলালেন। বড় করে একটা শ্বাস ফেললেন। তোকে একটা দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাই বাদল।
জ্বী বলেন কাকা।
ভগবানের দয়ায় কখনও যদি ফিরে আসি তো এলাম, যদি না আসি, আমার বড়িটা তুই বিলুকে দিয়ে দিস বাবা।
আচ্ছা কাকা।
বিলুটা অনাথ ছেলে, ওর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমার বাড়িতে জীবনভর যেন ও থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা তুই করে দিস বাবা।
জলধরের কথা শুনে বিলু তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
জলধর ডাক্তার বিলুর মাথায় হাত বুলালেন। কাঁদিস না বিলু, কাঁদিস না।
এই অবস্থায় জলধরকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল বিলু।
তারপর গেল মাধবিকে সালাম করতে। পাগলের মতো দুহাত বিলুকে বুকে জড়িয়ে ধরল মাধবি। দুজন মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে গেল খালপারের বাতাস।
.
২১.
মির্জা সাহেবের কথা শুনে শিরিন একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। কী বলছেন ভাইজান?
মির্জা সাহেব বললেন, ঠিকই বলছি।
এই অবস্থায় বিয়ে?
অবস্থার কথা ভেবে লাভ নেই। আমার ছেলেকে তোর পছন্দ কিনা তাই বল।
শিরিন আনমনা গলায় বললেন, বাদলের মতো ছেলেকে কে অপছন্দ করবে?
শিরিনের কথা শুনে মির্জা সাহেব খুব খুশি। তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। দশদিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাবে।
কিন্তু দেশের এই অবস্থা! বিয়ের খরচাপাতি?
কোনও খরচাপাতি নেই।
জ্বী?
ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে বোনের মেয়ের বিয়ে! এই ধরনের বিয়েতে আবার খরচা কিসের?
মুহূর্তে এই খবর ছড়িয়ে গেল পুরো বাড়িতে।
বাদলের কানে খবরটা গেল বরকতের মাধ্যমে।
শুনে বাদল একেবারে হতভম্ব। কী বলছ চাচা?
বরকত হে হে করে একটু হাসল। জেনে শুনেই বলছি। যমুনার সঙ্গে তোমার বিবাহ। দশ বারোদিনের মধ্যে। কথা ফাইনাল।
এসব শুনে বরকতের মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল বাদল তারপর মা বাবার ঘরে এসে ঢুকল।
মির্জা সাহেব ঘরে নেই। বকুল আছেন।
মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে রাগে একেবারে ফেটে পড়ল বাদল। এই অবস্থায় তোমরা এসব ভাবলে কী করে?
বকুল পরিষ্কার গলায় বললেন, আমি ভাবনি।
তাহলে?
তোর বাবা ভেবেছেন।
বাবাকে তুমি বোঝালে না কেন?
তিনি কি কারও কথা শোনার লোক? নিজে যা ভাল বোঝেন তাই করেন।
একটু থামলেন বকুল। তবে যমুনাকে আমারও পছন্দ। লেখাপড়া জানা লক্ষ্মীমেয়ে।
বাদল আগের মতোই রাগি গলায় বলল, তার মানে তোমারও মত আছে?
তোর মত নেই? যমুনাকে তোর পছন্দ না?
একথা শুনে বাদল একটু দমল। পছন্দ অপছন্দের কথা আমি বলিনি মা।
তাহলে?
আমি বলছি সময়ের কথা। যেখানে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চলছে সেখানে আমার মতো ছেলে বিয়ে করতে পারে না।
একটু থামল বাদল। আমি অবশ্য বুঝেছি বাবা কেন এই পলিসিটা করেছেন। আজ তোমাকে আমি স্পস্ট বলছি মা, তোমাদের কোনও পলিসিই কাজে লাগবে না।
বাদল রাগি ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল।
.
২২.
কথাটা যমুনা শুনল খুকির কাছ থেকে।
বিকেলবেলা খুকির মাথা আঁচড়ে দিচ্ছে যমুনা, খুকি বলল, তোমার জন্য একটা খবর আছে যমুনা আপা।
কী খবর?
তোমার বিয়ে।
যাহ।
সত্যি?
কোথায়?
এই বাড়িতে।
মানে?
মানে ভাইজানের সঙ্গে তোমার বিয়ে।
কী?
হ্যাঁ।
তোকে কে বলল?
বাড়ির সবাই জানে। তোমার যদি বিশ্বাস না হয়, তুমি গিয়ে ফুফুকে জিজ্ঞেস কর।
খুকির মাথা আঁচড়ানো শেষ না করেই পুবের ঘরে এল যমুনা।
শিরিন ঘরেই ছিলেন। সরাসরি তাঁকে কথাটা জিজ্ঞেস করল যমুনা।
শিরিন বললেন, যা শুনেছিস তা ঠিক।
মানে?
মানে বাদলের সঙ্গে তোর বিয়ে।
তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? কেন?
দেশের এই অবস্থায় কোনও পাগল ছাড়া কেউ নিজের মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতে পারে না।
চোখ তুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন শিরিন। এসব ব্যাপারে তুই যে আমার সঙ্গে কখনও কথা বলবি, এ আমি ও ভাবিনি।
নিজের ভালমন্দের ব্যাপারে কথা বলার অধিকার আমার আছে।
তা আছে। প্রত্যেক মানুষেরই থাকে।
যমুনা গম্ভীর হল। কী বলতে চাচ্ছ তুমি?
শিরিন থমথমে গলায় বললেন, তোকে সাত বছরের রেখে তোর বাবা মারা গেলেন। যে বয়সে আমি বিধবা হলাম সেই বয়েসে অনেক মেয়ের বিয়েই হয় না। আমারও অধিকার ছিল তোর কথা না ভেবে নিজের কথা ভাবা। কই আমি তো তা ভাবিনি।
দুটো ব্যাপার কিন্তু একরকম নয় মা।
তাহলে কী রকম?
আমি কিন্তু তোমার কথার অবাধ্য হচ্ছি না। তোমাদের সিদ্ধান্তেও আমার আপত্তি নেই।
তাহলে সমস্যাটা কী?
সমস্যা হচ্ছে দেশ। একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে যেখানে সেখানে একটি মেয়ের বিয়ে হয় কী করে?
পরিস্থিতিটা মনে না রাখলেই হয়।
যমুনার দিকে আর তাকালেন না শিরিন। নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
যমুনার তখন কী যে অসহায় লাগছে! চোখ ফেটে যেতে চাইছে গভীর কান্নায়।