বাদলের মুখের দিকে তাকাল যমুনা। আপনি কী বলেছেন যে আমি শুনেছি?
সকালবেলা বললাম উঠে হাঁটাচলা কর আর বিকেলবেলাই হাঁটাচলা করছ!
সেটা আপনার কথায়ই যে করছি তা আপনি বুঝলেন কী করে?
আমার মনে হলো।
অনেক ভুল কিছুও মানুষের মনে হয়।
তা হয়।
আচ্ছা আপনি কি সকালবেলা আমাকে খেয়াল করে দেখেছেন?
অবশ্যই।
আপনার দিকে যে আমি খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তা কি আপনি দেখেছেন?
দেখেছি।
কেন তাকিয়ে ছিলাম বলুন তো?
জানি না।
দেশের এই অবস্থায় ইউনিভার্সিটি পড়া কোনও ছেলে যে বাড়ি বসে থাকে, এই ভেবে।
বাদল একটু থতমত খেল। তারপর হাসল। বসে থাকিনি তো!
তাহলে কী করছেন?
দেশের কাজ করছি।
কী কাজ?
আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ অর্গানাইজ করছি। প্রাথমিক ট্রেনিংটা নিয়েছি। একেকটা গ্রুপ করে ইন্ডিয়া পাঠাচ্ছি।
একথা শুনে যমুনার জ্বরক্লান্ত মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। সত্যি?
দেশ নিয়ে কি আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলব!
না তা নয়।
তবে তোমাকে আমার খুব ভাল লাগল।
যমুনা একটু চমকাল। মানে?
মানে দেশ নিয়ে তোমার ফিলিংসটা জেনে ভাল লাগল।
যমুনা হাসল। তাই বলুন।
চল কোথাও বসি।
চলুন।
মাঠের ধারে অনেকগুলো খড়ের গাদা। বিকেলে রোদ খড়ের গাদার মাথার ওপর উঠে গেছে। তলার দিকটায় ছায়া। এখানটায় এসে বসল ওরা দুজন।
এই দৃশ্যটা দেখে ফেললেন মির্জা সাহেব।
আছড়ের নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছিলেন তিনি, খড়ের গাদার ছায়ায় বাদল এবং যমুনাকে দেখতে পেলেন। দেখে চোখে মুখে সামান্য একটা চিন্তা খেলে গেল তার।
তবে বাদল কিংবা যমুনা কেউ মির্জা সাহেবকে দেখতে পেল না।
যমুনা বলল, আপনি এভাবে কাজে করছেন, জেনে ভাল লাগল।
বাদল মুগ্ধ গলায় বলল, কাল সকালেই আমাদের আর একটা ব্যাচ চলে যাবে।
আপনি যাবেন কবে?
বাদল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমার বোধহয় যাওয়া হবে না।
কেন?
মায়ের জন্য।
তিনি কী করেছেন?
মায়ের কথাগুলো যমুনাকে বলল বাদল।
শুনে যমুনা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। এটা কোনও কথা হলো?
তবুও শেষ চেষ্টা আমি করব।
কীভাবে?
মাকে বোঝাব, তুমি যেমন আমার মা, দেশও তোমার মতো আরেক মা আমার। এক মায়ের কারণে আরেক মাকে আমি রক্ষা করব না!
বাদলের কথা শুনে কী যে ভাল লাগল যমুনার! একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। অপলক চোখে বাদলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
বাদল বলল, কী হলো?
না কিছু না।
তারপর যমুনা বলল, আপনার কথা শুনে নিজের জন্য আমার খুব দুঃখ হচ্ছে।
কেন?
ছেলে হলে, মানে মেয়ে না হয়ে যদি ছেলে হতাম, ঘরে আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারত না। দেশের জন্য দরকার হলে জীবন দিয়ে দিতাম আমি।
বাদল মুগ্ধ গলায় বলল, তোমার এই ফিলিংসটাই যথেষ্ট। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ সবাইকে করতে হয় না। তোমার মতো দেশাত্মবোধ যাদের আছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা।
তারপর একটু থেমে বলল, তোমাকে একটা কথা বলব?
আবার আগের মতো অপলক চোখে বাদলের দিকে তাকাল যমুনা। যে কোনও কথাই আপনি আমাকে বলতে পারেন।
তোমার নামটা আমার খুব ভাল লাগে। নদীর নামে নাম।
হ্যাঁ। শুধু নদী নয়, বাংলার বিখ্যাত নদী। আমার একটা প্রিয় শ্লোগান হচ্ছে,
‘তোমার আমার ঠিকানা
পদ্মা মেঘনা যমুনা’
যমুনা তখনও আগের মতোই চোখ করে তাকিয়ে আছে বাদলের দিকে। .
.
১৯.
কথাটা শুনে বকুল একেবারে আঁতকে উঠলেন। বল কী?
মির্জা সাহেব তার স্বভাব সুলভ গম্ভীর গলায় বললেন, আঁতকে উঠবার কিছু নেই। সত্য কথাই বলছি।
তাতো বুঝেছিই। তুমি কি আমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলবে?
মির্জা সাহেব হাসলেন। তবে ব্যাপারটা আমার অপছন্দ হয়নি।
কী?
মির্জা সাহেব মাথা নাড়লেন।
তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
না বোঝার কিছু নেই। যমুনা সুন্দরী মেয়ে। ওদের বংশও ভাল। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি। সবচে বড় কথা, বাদলের সঙ্গে ওকে খুব মানায়।
তার মানে তুমি কি ওদের বিয়ের কথা ভাবছ?
তবে কী?
দেশের এই অবস্থায় ছেলের বিয়ে?
এই অবস্থা বলেই তো বিয়ের কথা ভাবছি।
এবার বকুল কী রকম বিরক্ত হলেন। তুমি বড় প্যাচিয়ে কথা বল, কিছুই বুঝতে পারি না।
মির্জা সাহেব এবার নড়েচড়ে বসলেন। শোন, তুমি যদি সত্যি সত্যি গলায় দড়ি দাও তবুও তোমার ছেলে মুক্তিবাহিনীতে যাবে।
কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। এতদিন চলেও যেত।
তাহলে যায়নি কেন?
কেন যায়নি, আমি জেনে গেছি।
বল তো আমাকে।
ওর সঙ্গে যারা ছিল, সুজন মন্টু ওদেরকে গ্রামে দেখ?
না।
কেন দেখ না বল তো?
জানি না।
ওরা চলে গেছে।
মুক্তিবাহিনীতে চলে গেছে? ইন্ডিয়াতে?
হ্যাঁ। আর মাত্র কয়েকদিন, তোমার ছেলেও যাবে।
এজন্য বিয়ে করিয়ে দিতে চাও?
কারেক্ট।
বকুল হাসল। বুদ্ধিটা খারাপ না।
মির্জা সাহেব বললেন, বিয়ে দিয়ে যমুনাকে বলব, বাদলকে ধরে রাখ।
আমি যদি না পারি, যমুনা কি পরবে?
পারবে।
কী করে বুঝলে?
পুরুষমানুষরা এরকমই। মার কথা ফেললেও বউর কথা ফেলে না।
তুমি তাহলে শিরিনের সঙ্গে কথা বল।
দুচার দিনের মধ্যেই বলব।
.
২০.
বনসীমান্ত গ্রামের খালপারে আজ ভোরবেলা একখানা ছইঅলা নৌকো বাঁধা।
নৌকোয় মাঝারি সাইজের দুখানা হাত কিংবা কাঁধব্যাগ। কিছুক্ষণ আগে জলধর ডাক্তারের বাড়ি থেকে ব্যাগ দুটো বয়ে এনে নৌকোয় তুলেছে বিলু। তুলে আর ফিরে যায়নি। খালপারেই দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পরই জলধর ডাক্তার এবং মাধবি এলো খালপারে।
জলধরের পরনে আজ ধুতি নেই। পাজামা এবং পাঞ্জাবী পরেছেন। তিনি। মাধবির পরনে সাদাশাড়ি। তবে পাড় নেই শাড়ির।