সুমি খুব অবাক হলো।
এত রাতে অমির রুমে আলো জ্বলছে কেন? দরজাই বা খোলা কেন? নিজের রুমে না ঢুকে নিঃশব্দে অমির রুমের দরজা ঠেলল সুমি। ভেতরে ঢুকল। কিন্তু আমি তা টেরই পেল না। আগের ভঙ্গিতে কম্পিউটারের গায়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।
সুমি এসে অমির পাশে দাঁড়াল। তুই এখনও ঘুমোসনি?
অমি চমকাল। ও, আপা! না ঘুমোইনি। শুয়েছিলাম কিন্তু ঘুম আসেনি।
উঠে বাইরে গিয়েছিলি?
না।
তাহলে দরজা খোলা ছিল কেন? একথা শুনে মুখটা করুণ হয়ে গেল অমির। বন্ধ করতে মনে ছিল না।
সুমি আঁতকে উঠল। সর্বনাশ! আমাদের যে রকম বাড়ি, যে কোনও দিক দিয়ে চোর ঢুকে যাবে। এমনিতেই এত বড় বিপদ আমাদের, তার ওপর আরও বিপদ ঘটে যাবে। যদি কম্পিউটার চুরি হয়ে যায়?
আর এমন হবে না।
হ্যাঁ কিছুতেই যেন এমন না হয়। কোনও কোনও ফ্যামিলিতে মা বাবা ভাইবোন কেউ মারা যাওয়ার পর একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে। বাদলভাইদের ঘটনাটা জানিস না?
না, কী হয়েছিল?
বাদলভাইর মা যেদিন মারা গেলেন সে রাতে শটসার্কিট হয়ে বাদলভাইর ফ্ল্যাটের সব ফার্নিচার পুড়ে গেল না?
তাই নাকি? আমি শুনিনি তো!
হ্যাঁ, বাদলভাইর ফ্ল্যাটের সব ফার্নিচার পুড়ে গেছে তো। আবার সব ফার্নিচার নতুন করে বানিয়ে তবে ফ্ল্যাটে উঠেছেন তারা।
যে রাতে শটসার্কিট হয় সে রাতে বাদলভাইরা কোথায় ছিলেন?
ফ্লা্যাটেই ছিলেন। ধোয়া এবং আগুনে যখন সবদিক ভরে গেছে তখন কোনও রকমে বাচ্চাকাচ্চা এবং ভাবীকে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরুতে পেরেছিলেন।
ভাগ্যিস ঘুমটা ভেঙেছিল। ওমা, ওরকম ধোঁয়া আর আগুনে কারও ঘুম না ভেঙে পারে!
তারপর হঠাৎ করে বাদলভাইদের কুকুরটার কথা মনে পড়ল অমির। কবে যেন শুনেছিল ছোট্ট সুন্দর একটা কুকুর আছে বাদলভাইয়ের। বিদেশি কুকুর, ছবির মতো দেখতে। কুকুরটা নাকি খুবই প্রিয় তাদের।
সেই কুকুরটার কথা সুমিকে জিজ্ঞেস করল অমি। আপা, বাদলভাইদের কুকুরটা তখন কোথায় ছিল? কুকুরটার কোনও ক্ষতি হয়নি তো?
সুমি বলল, না। কুকুরটাকে চট করে কোলে নিয়েছিল বাদলভাইর ছোটমেয়ে অর্চি। কুকুর কোলে নিয়েই বেরিয়েছিল।
শুনে কী রকম একটা হাঁপ ছাড়ল অমি।
সুমি বলল, বাদলভাইরা বড়লোক মানুষ, ফ্ল্যাটের সবকিছু পুড়ে গেছে, তিন চারলাখ টাকার নাকি ক্ষতি হয়েছে, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমরা তো অতি গরিব এবং অসহায়, তার ওপর বাবা নেই, আমাদের সংসারে এখন যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে সবাই মিলে মারা পড়ব।
তারপরই সুমি খেয়াল করল অমি কম্পিউটার অন করেনি।
তাহলে কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে সে কী করছিল!
প্রশ্নটা অমিকে করল সুমি। তুই তো কম্পিউটার অন করিসনি। কী করছিলি?
অমি মাথা নীচু করে বলল, কিছু না।
মানে?
কম্পিউটারে হাত বুলাচ্ছিলাম।
কেন?
মনে হচ্ছিল বাবাকে ছুঁয়ে দিচ্ছি।
গলাটা কেমন ধরা ধরা অমির, বোধহয় চোখও ছলছল করছে। কিন্তু মাথা নীচু করে রেখেছে বলে ভাইর চোখ দেখতে পেল না সুমি।
অমি বলল, তোর মনে আছে আপা, আমার কম্পিউটারের শখ দেখে বাবা কোথা থেকে টাকা পয়সা ধার করে কম্পিউটার কিনে আনল! তখন কম্পিউটারের দামও বেশি ছিল।
ভাইয়ের কথা শুনতে শুনতে কখন জলে ভরে গেছে সুমির চোখ। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছল সে। আমরা দুজন ছিলাম বাবার জান। কোনও কিছু চাইলে যেমন করে হোক বাবা তা এনে দিতেন। যত কষ্ট হতো, এনে দিতেন। এটা বোঝার পর কোনও কিছুর শখ হলেও বাবাকে আমি তা বলতাম না।
একথা শুনে অমি আরও কাতর হলো। আমার তাহলে কম্পিউটারের শখ হওয়া ঠিক হয়নি আপা। কম্পিউটারের জন্য বাবাকে নিশ্চয় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
খুবই মায়াবি হাতে অমির কাঁধের কাছটা ধরল সুমি। এসব ভেবে মন খারাপ করিস না। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়।
বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে সুমি, অমি ডাকল। আপা।
সুমি ঘুরে দাঁড়াল। কী?
বাবা এভাবে কেন মরে গেল?
শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল সুমির। প্রায় ছুটে এসে অমির মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরল সে। ভাইবোন দুজনে মিলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
গভীর রাতের নির্জনতা ছাড়া এই কান্না কেউ টের পেল না।
.
০২.
কিছু বাজার যে করতে হয় আম্মা?
নিজের বিছানায় অসহায় মুখে বসে আছেন পারু। শিরিনের কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকালেন।
শিরিন বলল, ঘরে কিছু নাই। ফ্রিজ খালি।
পারু আনমনা গলায় বললেন, ডিম রান্না করো।
শিরিন সঙ্গে সঙ্গে বলল, ডিমই বা পামু কই?
পারু চমকালেন। ডিমও নেই?
না। একটাও নাই।
তাহলে কয়েকটা ডিম নিয়ে এসো।
ডিমের কাম কী, টেকা দেন, বাজারই কইরা নিয়াসি। বাজার আমি চিনি। করতে পারুম।
নিজের বালিসের তলায় খুচরো খাচরা টাকা রাখার স্বভাব আছে। পারুর। শিরিনের কথা শুনে বালিস তুললেন তিনি। না, টাকা পয়সা তেমন নেই। একটা মাত্র বিশ টাকার নোট পড়ে আছে। সেই নোটটাই শিরিনের হাতে দিলেন তিনি। ডিমই নিয়ে এসো।
টাকা হাতে নিয়ে পারু বলল, আইচ্ছা।
তারপর দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। একটা কথা কইতে চাইছিলাম আম্মা।
বল।
কইতে একটু শরমও করে, আবার না কইয়াও পারি না। মরা বাড়িতে এই হগল কথা কওন ঠিক না।
পারু বুঝে গেলেন শিরিন কী বলতে চাইছে। বললেন, তোমার বেতনের কথা?
জ্বে। এই তো আপনে বুইজা গেছেন। তিনমাস ধইরা দেন না। পোলাডা গেরামে থাকে আমার মার কাছে। ইসকুলে পড়ে। তিনমাস ধইরা তার কোনও খরচা দিতে পারি নাই।