স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে এই গান হচ্ছে। নিজের হাতলঅলা চেয়ারে বসে গান শুনছেন জলধর ডাক্তার। বাবার বিছানা গুছাচ্ছিল মাধবি। হ্যারিকেনের আলোয় মুখটা কেমন অসহায় দেখাচ্ছে তাঁর।
হঠাৎ জলধর বললেন, বাংলার জয় একদিন হবেই কিন্তু আমরা মনে হয় বাঁচব না।
মাধবি চমকাল। কেন বাবা?
বললে তুই খুব ভয় পাবি মা।
তবু বল। না বললে আমি অস্বস্তিতে থাকব।
জলধর হতাশ গলায় বললেন, দেশের একজন হিন্দুকেও বাঁচিয়ে রাখবে না ওরা।
শুনে আঁতকে উঠল মাধবি। মানে?
যেখানে যত হিন্দু আছে বেছে বেছে মেরে ফেলবে। প্রত্যেক থানায়, প্রত্যেক গ্রামে হিন্দু খুঁজতে শুরু করেছে।
তাহলে?
কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আজ জলিল এবং তালেব এইসব কথাই বলল।
হাতের কাজ শেষ না করেই জলধরের পাশে এসে দাঁড়াল মাধবি। বাবার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, আমার খুব ভয় করছে বাবা।
ভয়ের কথাই।
চল আমরা তাহলে কলকাতা চলে যাই।
চোখ তুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন জলধর। এতদিনকার বসতবাড়ি, গ্রাম, গ্রামের মানুষজন, আমার বাঁধারোগি সব ছেড়ে চলে যেতে বলিস?
এছাড়া কী করব, বলো? বাঁচতে তো হবে। তবে দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। স্বাধীন হলে আবার ফিরে আসব।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কী করব। তালেব এবং জলিলের কথায় আমি অবশ্য তেমন কিছু ভাবিনি। ওরা বদলোক। আমি ভালই চিনি ওদেরকে। কোন মতলবে কথাটা ওরা বলেছে তাও বুঝেছি। তবে মিলিটারিরা যে হিন্দু পেলেই মারছে এটা সত্য।
কিন্তু একটা কিছু সিদ্ধান্ত তো নিতে হবে।
কী সিদ্ধান্ত নেব বুঝে উঠতে পারছি না।
হঠাৎ করেই যেন কিছু একটা মনে পড়ল মাধবির। উৎফুল্ল গলায় বলল, তুমি একটা কাজ কর বাবা, মির্জা কাকার সঙ্গে কথা বলে দেখ। তিনি বিচক্ষণ মানুষ। তিনি যা বলবেন তাই করব আমরা। তিনি সাহস দিলে থাকব, না হয় চলে যাব।
পরদিন সকালবেলাই মির্জা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন জলধর। সব শুনে চিন্তিত গলায় মির্জা সাহেব বললেন, ভরসা আমি তোমাকে দিতে পারছি না ডাক্তার। দেশের অবস্থা তুমি আমি সবাই জানি। এই অবস্থায় কে কাকে ভরসা দেবে বল?
জলধর প্রচণ্ড হতাশ হলেন। তার মানে তুমিও চলে যাওয়ার কথাই বলছ?
ভেবে দেখ?
জলধর ফাঁকা শূন্য গলায় বললেন, মা হারা মেয়েটাকে নিয়ে ছিলাম। মেয়েটাকে একা বাড়িতে রেখে রোগি দেখতে যেতাম। মনে হতো চারপাশের সবাই আপন। সবাই মেয়েটাকে আমার দেখে রাখবে। দেখে রেখেছেও। কোনও অনিষ্ট আমার মেয়ের হয়নি।
মির্জা সাহেব বললেন, এখন সেই ভয়ও আছে। চেয়ারম্যান সাহেব পিস কমিটি করেছেন, জলিল তালেবরা হচ্ছে রাজাকার। মিলিটারিদের সঙ্গে ডাইরেক্ট যোগাযোগ। ঘরের ইঁদুরে যদি বাঁধ কাটে তখন আর কিছু করার থাকে না।
জলধরের কাঁধে হাত দিলেন মির্জা সাহেব। জলধর, তুমি আমার ছোটবেলার বন্ধু। তুমি কোনও রিসক নিও না। মেয়ে নিয়ে চলেই যাও।
যাবই বা কেমন করে? পথেও তো কত বিপদ!
তবুও যাও। মালপত্র তেমন কিছু নেবে না। দুজনে সামান্য দুটো ব্যাগ নিয়ে রওনা দেবে। আমি শুনেছি কুষ্টিয়ার ওদিক দিয়ে বর্ডার পার হচ্ছে হাজার হাজার লোক।
মির্জা সাহেবের মুখের দিকে তাকালেন জলধর ডাক্তার। তুমি যখন বলছ, ওই পথেই যাব।
তারপর মির্জা সাহেবের একটা হাত জড়িয়ে ধরলেন জলধর ডাক্তার। গভীর আবেগে বললেন, এই জীবনে তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে কী না জানি না। তুমি আমার ছেলেবেলার বন্ধু। মনে হয় না কখনও কোনও দুঃখ তোমাকে আমি দিয়েছি। তবু নিজের অজান্তে যদি কখনও দিয়ে থাকি, বন্ধু, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।
সঙ্গে সঙ্গে জলধরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মির্জা সাহেব। দুই ধর্মের দুজন বয়স্ক মানুষ তারপর শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
.
১৮.
জ্বর ছেড়ে গেছে ঠিকই কিন্তু দুর্বলতা কাটেনি যমুনার।
ঘর থেকে একেবারেই বেরয় না সে। সারাক্ষণই শুয়ে থাকে। ছোট্ট শিশুকে যেভাবে ধরে ধরে খাওয়ান মা ঠিক সেইভাবে তাকে খাইয়ে দেন শিরিন।
আজ সকালেও যমুনাকে সেভাবে খাইয়ে দিচ্ছিলেন শিরিন।
শিরিনের হাতে এক পেয়ালা দুধ আর দুখানা চালের রুটি। একটা রুটির অর্ধেকটা আর সামান্য দুধ খেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল যমুনা। আর খাব না মা।
শিরিন অবাক হলেন। কেন?
ভাল লাগছে না।
জ্বর থেকে ওঠার পর খেতে কারই ভাল লাগে না। তবুও খেতে হয়। জোর করে খেতে হয়।
কিন্তু আমি পারছি না। মুখটা কেমন তেতো হয়ে আছে।
জ্বরের পর মুখ এমন হয়।
আবার শরীরও কেমন গুলাচ্ছে।
বমি বমি লাগছে?
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে আর একটু খেলেই বমি করে ফেলব।
হাতের খাবার সরিয়ে নিলেন শিরিন। তাহলে আর খাওয়ার দরকার নেই।
এসময় এই ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল বাদল।
প্রথমে যমুনার দিকে তাকাল সে। তারপর তাকাল শিরিনের দিকে। জ্বর এখন কেমন?
শিরিন বললেন, জ্বর নেই, তবে শরীর খুব দুর্বল।
জ্বর হলে শরীর দুর্বল হবেই। দু চারদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর যমুনার দিকে তাকাল বাদল। হাসিমুখে বলল, জোর করে ওঠার চেষ্টা কর। হাঁটাচলার চেষ্টা কর। দেখবে তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে গেছ।
যমুনা তখন কী রকম অবাক চোখে বাদলের দিকে তাকিয়ে আছে।
সেদিন বিকেলেই যমুনার সঙ্গে আবার দেখা হলো বাদলের।
মাঠের দিকে হাঁটতে বেরিয়েছে যমুনা, বাদল এসে তার সামনে দাঁড়াল। তুমি তাহলে আমার কথা শোন!