বিলু লাজুক গলায় বলল, এই বাড়িতেই।
মির্জা সাহেব বললেন, ওর যখন যে বাড়িতে ভাল লাগে, থাকে। এখন আমার বাড়িতে আছে দুদিন পর দেখবে তোমার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে।
তাহলে তো ভালই হয়। মেয়েটা একা থাকে। বিলু থাকলে তার একটা সঙ্গী হয়। আগে মেয়েটা একা বাড়িতে থাকত, ভয় পেতাম না, আজকাল ভয় লাগে।
বকুল বললেন, লাগবার কথাই।
মির্জা সাহেব বললেন, বিলু তাহলে আজ থেকে তোমার বাড়িতেই থাক।
তারপর বিলুর দিকে তাকালেন মির্জা সাহেব। কী বলিস বিলু?
বিলু মাথা নীচু করে বলল, ঠিক আছে।
.
১৫.
মুখে কোনো একখানা হাসি দিয়ে জলিল বলল, একখানা প্রস্তাব নিয়া আসছি মির্জা সাহেব।
মির্জা সাহেবও হাসলেন। বিবাহের প্রস্তাব?
আরে না।
তালেব বলল, এই বয়েসে আপনে আবার বিবাহ করবেন নাকি?
মির্জা সাহেব বললেন, তোমাকে এতকাল ছাগল হিসাবে জানতাম, ছাগল থেকে রামছাগল হয়েছ কবে?
তালেব একেবারে নিভে গেল।
মির্জা সাহেব বললেন, নিজের কথা বলছি না। বিবাহের উপযুক্ত ছেলে আছে আমার।
জলিল বলল, বাদ দেন ওইসব কথা। বিবাহের ব্যাপার না।
তবে?
ব্যাপার হইতাছে পূর্ব পাকিস্তান।
বুঝলাম।
পূর্ব পাকিস্তানটারে আমরা বাঁচাইতে চাই।
তোমরা মানে?
জলিল তালেবের দিকে তাকাল। তালেব তুই ক।
তালেব ছোট্ট করে গলা খাকারি দিল। আমরা, মানে মেলেটারি সাহেবরা, সাহেবগ লগে পূর্ব পাকিস্তানের যিনারা আছেন তিনারা….।
তালেবকে থামাল জলিল। এইবার তুই থাম। আমি কই।
মির্জা সাহেবের দিকে তাকাল জলিল। থানায় থানায়, ইউনিয়নে ইউনিয়নে পিস কমিটি হইতাছে, রাজাকার বাহিনী হইতাছে। আমাগ ইউনিয়নের চেরম্যান সাবের কাছে প্রস্তাব আসছে…..।
জলিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই মির্জা সাহেব বললেন, এসবের মধ্যে আমি নেই।
তালেব বলল, আগে কথাটা শোনেন। চেরম্যান সাব আমগ ইউনিয়নের পিস কমিটিরও চেরম্যান হইছে।
জলিল বলল, আর আমি আর তালেব ভর্তি হইতাছি রাজাকারে। রাজাকারের কমান্ডার হমু। তালেব, ক।
তালেব বলল, চেরম্যান সাবে চায়, আপনে তার লগে থাকেন। সে চেরম্যান আপনে মেম্বর।
জলিল বলল, আর বিদ্যান পোলাডারে সামলান। তারে বলেন টেরনিং বন্দুক জয়বাংলা এইসব য্যান ছাইড়া দেয়। নাইলে…..।
চোখ তুলে জলিলের দিকে তাকালেন মির্জা সাহেব। নইলে?
অসুবিধা আছে আর কী?
মির্জা সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, ঠিক আছে, তোমরা যাও। আমি চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে কথা বলব।
তালেব এবং জলিল উঠে দাঁড়াল।
জলিল বলল, আর একখান কথা।
কী?
কোনও মোসলমানরে মেলেটারি সাবরা আর মারব না। বাইছা বাইছা খালি হিন্দুগুলিরে মারব।
জলিলরা বেরিয়ে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ চুপচাপ কাছারি ঘরে বসে রইলেন মির্জা সাহেব।
.
১৬.
রুগি দেইখা ফিরলেন ডাক্তার বাবু?
জলধর ডাক্তারের হাতে ডাক্তারি ব্যাগ, গলায় স্টেথিসকোপ। পরনে ধুতির ওপর ঝুল পকেটঅলা শার্ট। ধুতি এবং শার্ট দুটোই সাদা। পায়ে কালো পামসু আছে। চৌধুরী বাড়ির লাগোয়া পায়ে চলা পথে কিছুটা উদাস ভঙ্গিতে হাঁটছিলেন তিনি। তালেবকে খেয়াল করেননি। তার কথায় থতমত খেয়ে থামলেন। হ্যাঁ।
তারপর তালেবের সঙ্গে জলিলকেও দেখতে পেলেন। হাসিমুখে বললেন, তোমরা কোত্থেকে?
তালেব কথা বলবার আগেই জলিল বলল, তুই থাম। আমি কই।
তালেব এবং জলিল দুজনকেই আজ অন্যরকম লাগছে। কী রকম মাতাব্বর ভাব দুজনের মাতাব্বর চেহারায় কাউকে তোয়াক্কা না করার ভঙ্গি। অথচ এই দুজন গ্রামের অতি নিম্নস্তরের মানুষ। আজকাল তেমন কিছু করে না। বাজারের চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয় আর এর ওর
পয়সায় চা খায়। গ্রামের মানুষের কাছে ছ্যাচড়া হিসেবে পরিচিত।
সেই ছ্যাচড়া দুটো কোন ফাঁকে এমন বদলে গেছে!
জলধর যখন এসব ভাবছেন তখন জলিল বলল, এখন আমরা বড় বড় কাজে ঘুইরা বেড়াইতাছি, বোঝলেন ডাক্তার সাব?
জলধর হাসলেন, কী রকম বড় কাজ?
দ্যাশের কাজ আর কি। পাকিস্তানের কাজ। পূর্ব পাকিস্তানটারে বাচাইতে হইব।
জলধর একটু থতমত খেলেন। এই ধরনের কথা গ্রামের কারও মুখে কখনও শোনেন নি তিনি। অবাক গলায় বললেন, আচ্ছা।
সঙ্গে সঙ্গে কেমন খেঁকিয়ে উঠল জলিল। আইচ্ছা আইচ্ছা কইরেন না। আপনে অনেক বিপদ।
বিপদ কথাটা শুনে ভেতরে ভেতরে চমকালেন জলধর। বললেন, কী রকম বিপদ?
মেলেটারি সাবেরা একটা হিন্দুও এই দেশে রাখব না।
কী করবে?
এই কথাটার জবাব দিল তালেব। কী আর করব? মাইরা ফালাইব।
বল কী?
হ।
তুমি খবর পেয়েছ?
জলিল বলল, হ পাইছি। আমরা খবর না নিয়া কথা বলি না।
তারপর তালেবের দিকে তাকাল সে। তালেব তুই ক।
তালেব বলল, কী কমু?
ও তুই তো আবার জান না। ঠিক আছে আমিই কই। শোনেন ডাক্তার দাদা, পূর্ব পাকিস্তানে থাকলে বাঁচতে আপনেরা আর পারবেন না।
জলধর অসহায় গলায় বললেন, তাহলে কী করব?
চইলা যান। বাঁচতে চাইলে চইলা যান।
কোথায়?
আর কোথায়? কইলকাত্তা। বেবাক হিন্দুরা যেখানে যায়।
জলধর আর কথা বললেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন।
জলধর চলে যাওয়ার পর তালেবের দিকে তাকাল জলিল। ক তো। ডাক্তাররে চইলা যাইতে কইলাম কেন?
তালেব বলল, জানি না।
সে চইলা গেলেই বাড়িটা আমি দখল করুম। আমার বহুতদিনের শখ আমি একটা হিন্দুবাড়ি দখল করি। এইবার চান্সটা পাইছি।
.
১৭.
‘জয় বাংলা, বাংলার জয়
হবে হবে হবে
হবে নিশ্চয়’