তারপর দুকাঁধে দুটো ব্যাগ আর হাতে বিশাল সুটকেসটা নিল বরকত। আপা, তুমি যমুনাকে ধরে হাট।
যমুনা বলল, না ধরতে হবে না।
শিরিন মেয়েকে ধরলেন। অবশ্যই ধরতে হবে নয়তো যখন তখন পড়ে যাবি।
কিন্তু মামা অতগুলো লাগেজ একা কীভাবে নেবে?
আমাকে নিয়ে তুই ভাবিস না। আমি পারব?
এই লোকটিকে তেমন পছন্দ হয়নি বিলুর, তবু সে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আপনে একা এতগুলি পারবেন না। আমারে একটা দেন।
বরকত বলল, তুই কি মির্জাবাড়ি চিনিস?
খুব ভাল চিনি। এই গ্রামের সব বাড়িই আমি চিনি। যখন যেই বাড়িতে ইচ্ছা থাকি।
এখন থাকিস কোথায়?
মির্জাবাড়িতেই।
তাহলে তো ভালই। সেই বাড়ি পর্যন্ত এই সুটকেসটা নিতে কত নিবি?
কিছুই নেব না।
যমুনা বলল, কেন?
আমি কুলি না। পয়সার জন্য কাজ করি না। এমনিতেই গ্রামের সবার কাজ করে দিই।
বরকত খুব খুশি হলো। তাহলে তো আরও ভাল।
যমুনা বলল, কিন্তু এতবড় সুটকেস ও পারবে?
বিলু বলল, পারব। তবে মাথায় তুলে দিতে হবে।
তা আমি দিচ্ছি।
বলেই সুটকেসটা বিলুর মাথায় তুলে দিল বরকত।
দৃশ্যটা যমুনার ভাল লাগল না।
.
১৩.
দুপুরবেলাই মির্জা সাহেব টের পেয়ে গেলেন তাঁর বন্দুকটা নেই।
কী কারণে আলমারি খুলেছিলেন, বন্দুক এবং গুলির ব্যাগ না দেখে। সেই কারণটা ভুলে গেলেন। বকুলকে ডেকে বললেন ঘটনাটা।
বকুল ফ্যাল ফ্যাল করে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মির্জা সাহেব হতাশ ভঙ্গিতে খাটে বসলেন। শেষ পর্যন্ত তোমার ছেলে আমার বন্দুকটা চুরি করল! ছি ছি ছি! ইউনিভার্সিটিতে পড়া ছেলে এমন হয়! বাপের বন্দুক চুরি করেছে ছেলে, একথা কাউকে বলা যাবে!
এই ঘরের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল খুকি। বাবার কথা সে শুনতে পেল। পেয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বাবা, বন্দুকটা ভাইজান চুরি করেনি।
মির্জা সাহেব এবং বকুল দুজনেই খুকির দিকে তাকালেন
মির্জা সাহেব বললেন, তাহলে কে করেছে?
আমি।
কী?
মির্জা সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে নির্ভীক গলায় খুকি বলল, হ্যাঁ বাবা, আমি করেছি।
বকুল বললেন, কিন্তু তুই বন্দুক দিয়ে কী করবি?
ভাইজানকে দিয়ে দিয়েছি।
তখুনি বিশাল একখানা সুটকেস মাথায় নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল বিলু। উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ও খুকি, খুকি, তোমগ বাড়িতে মেহমান আসছে।
সব ভুলে উঠোনের দিকে তাকাল খুকি।
বিলুর পিছু পিছু তখন তিনজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে উঠোনে। তাদেরকে দেখে লাফিয়ে উঠল খুকি। মা, যমুনা আপা এসেছে। শিরিন ফুফু, বরকত চাচা সবাই এসে পড়েছে।
দৌড়ে উঠোনে চলে এল খুকি।
ঘরের ভেতর বকুল তখন মির্জা সাহেবকে বলছেন, বন্দুক টলুক নিয়ে এখন আর কোনও কথা বল না। যা হওয়ার হয়ে গেছে।
.
১৪.
যমুনাদেরকে থাকতে দেয়া হয়েছে পুবের ঘরে।
বিকেলবেলা সেই ঘরের পালঙ্কে শুয়ে আছে যমুনা। তার মুখে থার্মোমিটার, গায়ে লেপ। অদূরে হাতলঅলা চেয়ারে বসে আছেন জলধর ডাক্তার। আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই বাড়ির সবাই। মির্জা সাহেব বকুল বাদল খুকি শিরিন বরকত নবু বিলু।
শিরিন বললেন, জ্বরটা এসেছে ভয়ে। সারাক্ষণ ভয়ে উৎকণ্ঠায় মেয়েটা আমার জড়সড় হয়ে থাকত।
মির্জা সাহেব বললেন, এই বয়সি মেয়ে নিয়ে ঢাকায় এতদিন তুই থাকলি কেন?
বকুল বললেন, তোমার নিজেরও তো কাঁচা বয়েস।
বরকত বলল, আমাদের মোহাম্মদপুর এলাকায় কোনও ঝামেলা নেই।
জলধর বললেন, মানে?
বিহারি এলাকা তো! মিলিটারিদের সঙ্গে বিহারিদের খুব খাতির।
ভাইকে একটা ধমক দিলেন শিরিন। চুপ কর। বিহারিগুলো আরও খচ্চর। ওদের কারণেই বাড়ি থেকে বেরুতে পারিনি। পিস কমিটি, রাজাকার বাহিনী, বদর বাহিনী, কত বাহিনী হয়েছে। একটি বাঙালিকেও ওরা বাঁচিয়ে রাখবে না।
যমুনার মুখ থেকে থার্মোমিটার টেনে নিয়ে, জ্বর দেখতে দেখতে জলধর বললেন, ওই এলাকা থেকে আপনারা তাহলে বেরুলেন কী করে?
মির্জা সাহেব বললেন, ডাক্তার, ওকে তুমি করে বল। আমার ফুফাতো বোন। অল্প বয়েসে বিধবা হয়েছে।
বিধবা শব্দটা শুনেই মুখখানি মায়াবি হয়ে গেল জলধরের। আমার মাধবির মতো। তবে ভগবানের দয়ায় মাধবির কোনও সন্তানাদি নেই।
শিরিন বললেন, জ্বর কত ডাক্তার বাবু?
এমন কিছু না। একশো এক। অষুদ দিয়ে যাচ্ছি, খাবে। আর একটা দুটোদিন রেস্ট নেবে, তিনদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
ব্যাগ খুলে প্রেসক্রিপসান প্যাড বের করলেন জলধর ডাক্তার। পকেট থেকে খয়েরি রংয়ের মোটা প্রেসিডেন্ট কলম বের করলেন। তারপর খসখস করে কী কী সব লিখলেন। লিখে শিরিনের হাতে দিলেন। এটা ধর। ট্যাবলেট দিচ্ছি।
ব্যাগ থেকে দুপাতা ট্যাবলেট বের করলেন। একটা করে তিনবেলা খাবে। খাওয়ার পর।
কদিন?
পাঁচদিন। ভগবানের দয়ায় পাঁচদিনেই দেখবে একদম ঠিক।
ব্যাগ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন জলধর। আজ আর বসতে পারছি না।
বকুল বলল, কেন দাদা?
সন্ধে হয়ে যাচ্ছে।
মির্জা সাহেব বললেন, চা খাবে না?
না। আজ খাব না। মেয়েটা একা বাড়িতে।
তারপর শিরিনের দিকে তাকালেন জলধর। কাল এক সময় এসে তোমার যমুনাকে একবার দেখে যাব। কীভাবে ঢাকা থেকে বেরুলে সেই ঘটনাও শুনে যাব।
বিলু এগিয়ে এসে জলধর ডাক্তারের ব্যাগটা ধরল। ব্যাগটা আমার হাতে দেন। আমি দিয়াসি।
বিলুকে দেখে কেমন যেন খুশি হলেন জলধর। কী রে বিলু, তুই এখন থাকিস কোথায়?