তারপরই স্ত্রীর কাঁধে হাত দিলেন মির্জা সাহেব। শোন, বাদলের দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে। সে তোমার কথা শোনে। তাকে তুমি বোঝাও। সব ছেড়ে ঘরে বসে থাকতে বল। দেশ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমাদের কোনও লাভ নেই। ছেলে গেলে কিন্তু ছেলে পাবে না।
বকুল কথা বললেন না।
পরদিন সকালবেলা বাদলের ঘরে এসে ঢুকলেন বকুল।
শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বেরুচ্ছিল বাদল। মাকে দেখে থামল।
বকুল বললেন, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।
পরে বলো। আমি এখন বেরুচ্ছি।
বাদলের হাত ধরলেন বকুল। না, এখুনি বলব।
কী এমন কথা যে এখুনি বলতে হবে?
খুবই জরুরী কথা।
ছেলেকে টেনে এনে বসালেন বকুল। আমার কথা শুনে তারপর বাইরে যাবি।
আচ্ছা বল।
তোকে সব ছেড়ে দিতে হবে।
কথাটা বুঝতে পারল না বাদল। বলল, কী ছেড়ে দিতে হবে?
দেশ নিয়ে চিন্তা ভাবনা। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং, সবকিছু।
মায়ের কথা শুনে বাদল একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। আমার মা হয়ে এমন কথা তুমি বলছ?
কেন খারাপ কী বলেছি?
তোমার মতো কত মায়ের সন্তান দেশ বাঁচাবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর আমাকে তুমি ঘরে আটকে রাখতে চাও?
বকুল আবদেরে গলায় বললেন, আমি কিছু বুঝি না, কিছু শুনতে চাই না। তুই কোথাও যেতে পারবি না। যদি পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে যাস তাহলে আমি গলায় দাড়ি দেব।
বাদল আঁতকে উঠল। মা!
বকুল কঠিন গলায় বললেন, যদি দেখতে চাস আমি গলায় দড়ি দিয়েছি,তাহলে যেখানে ইচ্ছে চলে যা। আমার কিছু বলার নেই।
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন বকুল। চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।
বাদল স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
.
১১.
সকালবেলা বাবা গিয়ে বসেছেন কাছারি ঘরে আর মা ভাইজানের ঘরে। এই সুযোগে মা বাবার ঘরে এসে ঢুকেছে খুকি। আলমারির চাবিটা কোথায় থাকে জানা আছে ওর।
চাবিটা খুকি বের করল।
তারপর সাবধানী চোখে চারদিক তাকিয়ে আলমারি খুলল।
এই আলমারিতেই থাকে বাবার বন্দুক, গুলির ব্যাগ। অতি সাবধানে দুটো জিনিসই বের করল খুকি। তারপর আলমারি তালাবন্ধ করে, চাবি জায়গা মতো রেখে বন্দুক আর গুলির ব্যাগ নিয়ে ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরুল।
জিনিস দুটো বয়ে আনতে একটু কষ্ট হলো তার। তবুও ঘুর পথে তাদের বাড়ি থেকে বেরুবার পথের ধারে, বাঁশঝাড় তলায় এসে দাঁড়িয়ে রইল সে।
কিছুক্ষণ পরই এই পথ দিয়ে আনমনা ভঙ্গিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল বাদল।
খুকি তাকে ডাকল। ভাইজান, দাঁড়াও।
বাদল দাঁড়াল। তুই এখানে কী করছিস।
তারপর বন্দুক দেখে অবাক হলো। এ কী? বন্দুক? বন্দুক কোথায় পেলি?
গুলিও আছে। নাও।
বলে বন্দুক আর গুলির ব্যাগ বাদলের হাতে দিল।
বাদল তখনও অবাক। বাবার বন্দুক, গুলি এসব তুই কীভাবে জোগাড় করলি?
খুকি হাসিমুখে বলল, যেমন করেই হোক করেছি। তুমি নাও।
কিন্তু বাবা জানতে পারলে?
কী করবে? মারবে আমাকে? মারুক।
সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য এক আনন্দে মন ভরে গেল বাদলের। খুকির মাথায় হাত দিল সে। তোর মতো বোন যে দেশে আছে সেই দেশের স্বাধীনতা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
ভাইয়ের কথায় উজ্জ্বল হাসিতে মুখ ভরে গেল বোনের।
বন্দুক আর গুলির ব্যাগ হাতে বাদল সোজা চলে এল বটতলায়। এখানে আলমগিররা সবাই আছে।
বন্দুকটা আলমগিরের হাতে দিল বাদল।
আলমগির মুগ্ধ গলায় বলল, শেষ পর্যন্ত তাহলে আনলি?
বাদল লাজুক গলায় বলল, হ্যাঁ।
সুজন বলল, বেশ খানদানি বন্দুক।
বাদল বলল, রাখ এসব। মন্টুরা কখন রওনা দিল তাই বল।
ভোররাতে।
কুমিল্লার ওদিক দিয়েই তো বর্ডার পার হবে, নাকি?
হ্যাঁ।
সুজন বলল, আমার খুব ফূর্তি লাগছে।
কারণ?
কারণ পরের ব্যাচে যাব আমি।
.
১২.
শিরিন বললেন, আর চিন্তা নেই মা। এসে পড়েছি।
মুমূর্ষ ভঙ্গিতে শুয়েছিল যমুনা। একে জ্বর তার ওপর নৌকোর দুলুনি, মাথাটা বন বন করে ঘুরছে তার। তবু নৌকোর ভেতর থেকে বাইরের দিকে তাকাল।
নৌকো ততোক্ষণে খালপারের ঘাট ছুঁয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে মাঝিকে তাড়া দিল যমুনার ছোটমামা বরকত। ব্যাগ সুটকেস তাড়াতাড়ি নামাও।
খালপারে লগি পুতে নৌকো বাঁধল মাঝি। তারপর ব্যাগ সুটকেস নামাতে লাগল।
অকারণেই ঘুরতে ঘুরতে খালপারে এসেছিল বিলু। হঠাৎ ছইঅলা নৌকো এবং অচেনা মানুষজন দেখে নৌকোর কাছে এল সে।
যমুনাকে জড়িয়ে ধরে ততোক্ষণে নৌকো থেকে নেমেছেন শিরিন। বিলু এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। আপনেরা ঢাকা থেকে আসলেন?
শিরিন বলল, হ্যাঁ।
ঢাকার খবর কী?
শিরিনের পেছন থেকে বরকত তাকে একটা ধমক দিল। চুপ কর।
বিলু তার ডাগর চোখ দুটো তুলে বরকতের দিকে তাকাল। ক্যান? কোনও অন্যায় কথা বলছি?
মাঝির ভাড়া দিতে দিতে বরকত বলল, অন্যায় নয় তো কী! এইটুকু পুঁচকে ছোঁড়া, তুই খবরের কী বুঝিস?
জ্বরের ঘোরেও বিলুকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল যমুনা। শ্যামল বরণ মিষ্টি ছেলেটি। মুখখানি কী মায়াবি! চোখ দুটো কী সুন্দর! কথা বলার সময় কী সুন্দর করে হাসে!
শিরিনের দিকে তাকিয়ে বরকত বলল, যমুনার জ্বর কেমন, আপা?
শিরিন বললেন, এখন তেমন জ্বর নেই।
যমুনা মুমূর্ষ গলায় বলল, তবে আবার আসবে।
তা বুঝতে পারছি।
ডাক্তার না দেখালে হবে না।
হ্যাঁ, আজই ডাক্তার দেখাব। এখন তো আর কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু ওইটুকু হেঁটে যেতে পারবি মা?
পারব।
বিলু হাসিমুখে যমুনার দিকে তাকাল। কোন বাড়িতে যাবেন আপনারা?
যমুনা কথা বলবার আগেই বরকত বলল, মির্জাবাড়ি।