মন্টু বলল, আমরা ছোটবেলা থেকেই জানি বাদলের যা কিছু দরকার তা ও ওর মাকেই বলে।
এনামুল বলল, বন্দুকটার কথাও তাহলে মাকেই বল।
বাদল আগের মতোই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
আলমগির বাদলের দিকে তাকাল। হ্যাঁ মাকেই বল বাদল।
সুজন বলল, এনামুল ভাইর সঙ্গে আমিও একমত। উচিত ছিল। তোদের বাড়ির বন্দুকটাই আগে জোগাড় করা।
এনামুল বলল, এ কদিন আমি তোমাকে ইচ্ছে করেই বলিনি বাদল।
এবার মুখ তুলল বাদল। কেন?
দেখতে চেয়েছি তুমি কী কর।
বাদল লাজুক গলায় বলল, আপনার কথা আমি বুঝেছি।
এনামুল গম্ভীর গলায় বলল, বুঝে থাকলে আর কিছু বলার নেই। আশা করি বন্দুকটা তুমি আজই নিয়ে নেবে।
কিন্তু বাদলের কথা শুনে বকুল গম্ভীর হয়ে গেলেন। তোর বাবাকে এসব কথা আমি বলতে পারব না।
বাদল বলল, কেন?
রাগি মানুষ। আমার ওপর রেগে যাবেন।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মা এবং ভাইয়ের কথা শুনছে খুকি। বকুল এবং বাদল কেউ তা খেয়াল করল না।
বাদল বলল, কিন্তু আমি কোনও অন্যায় আবদার করছি না মা।
তা আমি জানি।
গ্রামে যার যার বন্দুক আছে তাদের প্রত্যেকেরটাই আমরা নিয়ে নিয়েছি। এই তো সেদিন ডাক্তার কাকারটা নিয়ে এলাম। চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিলেন।
বুঝলাম। তুই তাহলে একটা কাজ কর, নিজে গিয়ে তোর বাবাকে বল।
বাদল বেশ বিরক্ত হলো। ঠিক আছে, আমিই বলব।
খুকির পাশ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল বাদল।
খুকির মুখটা তখন কী রকম চিন্তিত দেখাচ্ছে। বাদলকে গিয়ে কাছারি ঘরে ঢুকতে দেখল সে। তারপর নিজেও কাছারি ঘরের দিকে পা বাড়াল।
কিন্তু খুকি পৌঁছার আগেই কথাটা মির্জা সাহেবকে বলে ফেলেছে বাদল। খুকি এসে দরজার সামনে দাঁড়াতেই শুনতে পেল মির্জা সাহেব থমথমে গলায় বলছেন, না বন্দুক আমি দেব না।
বাদল বলল, কেন?
পুরো কথাটা শোন। বন্দুক তো আমি দেবই না, তোকে ওসব ট্রেনিং ফ্রেনিংও আর করতে দেব না। এসব তোকে ছাড়তে হবে।
বাদল আবার বলল, কেন?
রাগি চোখে ছেলের দিকে তাকালেন মির্জা সাহেব। কেন মানে? এসব করে কী হবে? এভাবে একটা দেশ স্বাধীন করা যায়?
জীবনে এই প্রথম বাবার মুখের ওপর দৃঢ় গলায় কথা বলল বাদল। এভাবেই দেশ স্বাধীন করা যায়। যখন দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতা চায় তখন তাদের স্বাধীনতা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না।
দেশের সবাই স্বাধীনতা চায় না।
কে বলেছে আপনাকে।
আমি জানি। পাকিস্তানিদের পক্ষেও কিছু লোক আছে।
তা থাকলেও কিছু যায় আসে না।
মির্জা সাহেব খরচোখে বাদলের দিকে তাকালেন। তোর কথাবার্তা শুনে খুবই অবাক হচ্ছি আমি।
কী রকম?
এই প্রথম দেখছি তুই আমার সঙ্গে তর্ক করছিস।
এটা তর্ক না। সত্য কথা।
থাম। কোন ফাঁকে এরকম বেয়াদব হয়ে উঠেছিস তুই?
আমি কোনও বেয়াদবি করিনি।
অবশ্যই করেছিস। ভালভাবে চাইলে বন্দুকটা তোকে আমি দিয়ে দিতাম।
আমি ভাল ভাবেই চেয়েছি।
তা তুই চাসনি। তুই আমার সঙ্গে তর্ক করেছিস।
বাদল কথা বলল না।
মির্জা সাহেব আগের মতোই রুক্ষ গলায় বললেন, এই যে আমার সঙ্গে তর্কটা করলি, বন্দুকটা এজন্য তোকে আমি দেব না। যা, তুই যা। আমার সামনে থেকে।
বাদল খুবই মন খারাপ করে বেরিয়ে গেল।
ভাইয়ের জন্য খুকির তখন মনটা কেমন করছে।
.
০৯.
সন্ধেবেলা এনামুলের বাড়ির উঠোনে এসেছে বাদলরা কয়েকজন।
এনামুল বলল, প্রাথমিক ট্রেনিংটা তোমাদের অনেকেরই হয়ে গেছে। এখন অন্যকাজ।
বাদল বলল, কী কাজ?
তিন চারজনের একেকটা করে দল করতে হবে। দু একদিন পর পরই ওরকম একটি দুটি করে দল আগরতলায় পাঠিয়ে দেব। আসল ট্রেনিংটা হবে সেখানে। ফিরে এসেই যুদ্ধ।
প্রথম দলে আমি যেতে চাই।
না।
বাদল চমকাল। কেন?
তোমাদের নিয়ে আমার অন্য প্ল্যান আছে।
বাদল আলমগির সুজন মন্টু এই চারজন একসঙ্গে তাকাল এনামুলের দিকে।
এনামুল বলল, তোমরা চারজন যাবে একে একে।
আলমগির বলল, কেন?
হাত তুলে তাকে থামাল এনামুল। এত প্রশ্ন করো না। আমার কথা শোন। প্রথমে যাবে মন্টু। তার সঙ্গে আরও তিনটি ছেলে। কারণ কাল থেকে চার পাঁচটা গ্রুপ করে ট্রেনিং দেয়া হবে। আমি তো আছিই। আরেক দলে থাকবে বাদল, আরেক দলে আলমগির, আরেক দলে সুজন। এভাবে ট্রেনিং চলবে।
এনামুলের কথার পর কেউ আর কোনও কথা বলল না।
.
১০.
খুকির মুখে সবই শুনেছেন বকুল।
তখন থেকেই তাঁর মুখটা গম্ভীর।
রাতেরবেলা স্ত্রীর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে মির্জা সাহেব বললেন, মুখটা হাড়ির মতো করে রেখেছ কেন?
বকুল গম্ভীর গলায় বললেন, আমার মুখ হাড়ির মতোই।
না আমি জানি কেন এমন করে আছ।
জানোই যখন তাহলে আর কথা বলছ কেন?
তারপর একটু থেমে বলল, ছেলের সঙ্গে এই ধরনের ব্যবহার করা তোমার ঠিক হয়নি।
একথায় মির্জা সাহেবও গম্ভীর হলেন। তোমার ছেলেরও ঠিক হয়নি আমার সঙ্গে তর্ক করা।
কী তর্ক করেছে?
তুমি নিশ্চয় তা শুনেছ।
বকুল কথা বলল না।
মির্জা সাহেব গজগজে গলায় বললেন, লেখাপড়া শিখে বেয়াদব হয়ে গেছে।
আজকালকার ছেলেরা এরকমই।
বলেই চিন্তিত হলেন বকুল। তুমি বাদলের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করলে, আমি কিন্তু অন্যরকম একটা ভয় পাচ্ছি।
কিসের ভয়?
বাদল যদি পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে যায়? সেখানে গিয়ে যদি ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করতে আসে? যদি ছেলেটাকে আমরা আর কোনওদিন ফিরে না পাই?
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন বকুল।
স্ত্রীর কান্না দেখে মির্জা সাহেব কেমন দমে গেলেন। চিন্তিত গলায় বললেন, এসব আমিও ভেবেছি। ওর বয়েসি ছেলেরা কেউ ঘরে থাকছে না।