কথা শেষ করলেন না পারু।
সেলিম বলল, টাকা পয়সা এবং সামাজিক প্রতিপত্তির মোহ সবার থাকে না। প্রথম কথা হলো আপনাদের সবাইকে আমার খুব ভাল লেগেছে। তাছাড়া আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। বিষয়টিকে আমি খুব সম্মানের মনে করেছি।
এই বাড়ির কাজের বুয়ার নাম শিরিন। বহুদিন ধরে আছে। ফলে বাড়িতে কে এলে চা বিসকুট দিতে হবে, কী করতে হবে, সব তার জানা। বলতে হয় না কিছুই।
মাত্র কদিন আগে বাড়ির কর্তা মারা গেছেন। এই অবস্থায় বাড়িতে কাউকে আপ্যায়নের কোনও ব্যাপার নেই। তারপরও সেলিম এসেছে দেখে সেলিমের জন্য চা করেছে সে, যত্ন করে চা বিসকুট এবং একগ্লাস পানি নিয়ে এসেছে ড্রয়িংরুমে। এসে দেখে সেলিম এবং পারু খুবই মন খারাপ করা ভঙ্গিতে কথা বলছে। দেখে আর দাঁড়ায়নি। ট্রেটা ভাঙাচোরা সেন্টার টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে চলে গেছে।
দুজন মানুষের কেউ শিরিনকে দেখতে পায়নি।
এই রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শিরিন ভেবেছে কাজটা সে ঠিকই করেছে। দুদিন পর বাড়ির জামাই হবে যে, এনগেজম্যান্ট হয়েছে, অর্ধেক জামাই তো সে হয়েই আছে, বাড়ির অবস্থা যাই হোক চা বিসকুট তাকে দিয়ে পারা যাবে না। সেই গানের মতো। ঠাকুর জামাই এল বাড়িতে।
সেলিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাই যেন চায়ের ট্রেটা চোখে পড়ল পারুর। ব্যস্ত হলেন তিনি। চা খাও বাবা, চা খাও। আহা কোন ফাঁকে দিয়ে গেছে শিরিন, বোধহয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। দাঁড়াও, শিরিনকে ডাকি। গরম করে দিতে বলি।
সেলিম অমায়িক গলায় বলল, দরকার নেই। আপনি ব্যস্ত হবেন না। চা এখন আমি খাব না। আমি বরং সুমির সঙ্গে একটু দেখা করি।
হ্যাঁ, যাও বাবা, যাও। ওকে একটু সান্ত্বনা দাও। দিনরাত কান্নাকাটি করছে।
সেলিম তারপর সুমির রুমের দিকে চলে গেল। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তখনও কাঁদছে সুমি।
সেলিম এই রুমের দরজায় টুকটুক করে নক করল। চমকে দরজার দিকে তাকাল সুমি। তারপর চোখ মুছল।
সেলিম বলল, আসব?
সুমি আবার চোখ মুছল। তারপর মাথা নাড়ল।
সেলিম ভেতরে ঢুকল। যথারীতি গলা খাকারি দিয়ে বলল, দশ বারো দিন পার হয়ে গেছে তারপরও চোখের পানি ফুরাচ্ছে না তোমার?
সুমি ভেজা গলায় বলল, বাবার জন্য চোখের পানি আমার কোনও দিনও ফুরাবে না।
কিন্তু মৃত্যু এমন এক অমোঘ নিয়তি, মানুষের সাধ্য নেই মৃত্যুকে এড়িয়ে থাকার। কখনও না কখনও মৃত্যু আসবেই।
এসব বইয়ের কথা। সবাই জানে।
তারপরও এসব কথাই সারাজীবন ধরে বলতে হয়। মানুষকে সান্ত্বনা দেয়ার নতুন কোনও ভাষা আসলে তৈরি হয়নি। পুরনো কথাগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে হয়। তাছাড়া মৃত্যুও তো একটা পুরনো বিষয়। পৃথিবীর শুরু থেকে আছে, পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত থাকবে।
কিন্তু কী এমন বয়স হয়েছিল বাবার? মানুষ তো আশি নব্বই একশো বছরও বাঁচে!
একশো তিরিশ চল্লিশ বছর বাঁচার রেকর্ডও মানুষের আছে। আবার জন্ম মুহূর্তেও মরে যায় কোনও কোনও মানুষ। মাতৃগর্ভে মরে যায়।
একটু থামল সেলিম। সুমি, তোমার মনে হতে পারে তর্ক বিতর্ক করার জন্য কথাগুলো আমি বলছি। আসলে তা নয়। আসলে অনেক কথা বলে তোমার মন আমি অন্যদিকে ঘুরাতে চাচ্ছি। তোমরা সবাই মিলে যে রকম কান্নাকাটি করছ, এভাবে চললে তোমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়বে। অসুস্থ হলে বিপদ আরও বাড়বে। মন শক্ত কর, শক্ত হয়ে দাঁড়াও।
সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমি চাই, সত্যি আমি চাই মন শক্ত করতে, শক্ত হয়ে দাঁড়াতে। পারি না। আমার শুধু কান্না পায়।
বলে আবার একটু কাঁদল সুমি। ওড়নায় চোখ মুছল।
সুমির দিকে তাকিয়ে সেলিম বলল, কিন্তু তুমি বড়। তোমার দায়িত্ব অনেক। মায়ের কথা না হয় ভাবলে না, একমাত্র ভাইটির কথা তো ভাববে! তোমরা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করলে ওইটুকু ছেলের মনের অবস্থা কী হয় ভাব তো! তাছাড়া চারমাস পর ছেলেটির ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা!
ডানহাতখানা মায়াবি ভঙ্গিতে সুমির কাঁধে রাখল সেলিম। শক্ত হও, শক্ত হও।
এই হাতের স্পর্শে সুমির কান্না আরও গম্ভীর হলো।
.
০২.
অমির জানালায় অনেকদিনের পুরনো পর্দা।
ছেঁড়াখোঁড়া কোণা ঝুলে পড়েছে। তবুও পর্দা। পুরোপুরি না হলেও আলো কিছুটা ঠেকিয়ে রাখে। সকালবেলার রোদ, রাতেরবেলা লাইটপোস্ট থেকে আসা আলো এই পর্দার ফাঁক ফোকর দিয়ে অমির রুমে ঢোকেই।
আজ রাতেও ঢুকেছে।
সেই আলোর দিকে এখন তাকিয়ে আছে অমি। রাত গম্ভীর হয়েছে। কিন্তু চোখে ঘুম নেই তার। বাবার কথা মনে পড়ছে।
বাবার কথা মনে পড়লেই কম্পিউটারটার দিকে তাকায় অমি।
এখনও তাকাল। তারপর বিছানা থেকে নামল, নেমে লাইট জ্বালল। সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল রুম। কম্পিউটারটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল।
ধীর পায়ে কম্পিউটারের সামনে এসে দাঁড়াল অমি। প্রিয়জনকে আদর করার ভঙ্গিতে কম্পিউটারের গায়ে হাত বুলাতে লাগল।
ঠিক তখুনি নিজের রুম থেকে বেরিয়েছে সুমি।
রাতেরবেলা প্রায়ই পিপাসা পায় তার। এজন্য বিছানার পাশে এক বোতল পানি রাখে। আজ রাখতে ভুলে গিয়েছিল। পিপাসায় ঘুম ভাঙার
পর পানির বোতল না পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং স্পেসে এসেছে। সে। ফ্রিজ খুলে গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়েছে। তারপরই দেখতে পেয়েছে অমির রুমের দরজা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। সেই দরজা দিয়ে আলো আসছে।