আর কখনও দেশে ফেরেন নি?
না।
কেন?
দেশে কেউ ছিল না আমাদের।
আত্মীয় স্বজন কেউ না?
না। আমার দাদা দাদী আগেই মারা গিয়েছিলেন। আমার একজন ফুফু ছিলেন, সেই ফুফুকে বাবা পরে আমেরিকায় নিয়ে যান। আমার সেই ফুফুও নিউইয়র্কেই থাকেন। তার দুটো ছেলে। ফুফার একটা গ্রোসারিশপ আছে। নিজের সুন্দর বাড়ি। অবস্থা বেশ ভাল।
পারু বললেন, খুব ভাল লাগল বাবা। খুব খুশি হয়েছি। তোমার বাবা পুরনো দিনের কথা মনে রেখেছেন। দেশে এসে তুমি আমাদের খোঁজ খবর নিতে এসেছ। আজকাল কে কার কথা মনে রাখে, বল?
মনজু কথা বলল না। সুমি বলল, কিন্তু আপনি আমাদের ঠিকানা পেলেন কী করে?
বাবা বলে দিয়েছিলেন গেণ্ডারিয়া এলাকাতেই আছেন আপনারা। যুদ্ধের সময় যে বাড়ি ছিল হয়তো সেই বাড়ি এখন আর নেই। তবু খুঁজলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে।
কিন্তু আগের সেই বাড়ি তো নেই।
তবু পেয়ে গেলাম। খুব একটা খুঁজতে হয়নি। ইচ্ছে এবং চেষ্টা থাকলে সব হয়।
পারু বললেন, চা খেতে চাইছ না কেন?
সুমি বলল, চা না হয় অন্য কিছু একটু খান। এভাবে খালি মুখে বসে আছেন!
ঠিক আছে।
সুমি উঠতে যাচ্ছিল, পারু বললেন, তুই বোস। আমি যাচ্ছি।
পারু চলে যাওয়ার পর মনজু বলল, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমার অন্যরকমের কিছু ঝামেলা আছে।
সুমি বলল, কী রকম?
বাবা আমাকে বলেছেন পুরনো ঢাকায় বিকেলবেলা ঘন দুধের চা আর ডালপুরি, অসাধারণ টেস্টি। ভাবছিলাম আপনাদের এখান থেকে বেরিয়ে কোনও একটা রেস্টুরেন্টে বসে ওরকম চা আর ডালপুরি খাব। এজন্যই চাটা খেতে চাইনি।
মনজুর কথা শুনে চঞ্চল হলো সুমি। আগে বলবেন তো! ও রকম চা আর ডালপুরি আপনাকে আমি আনিয়ে দিচ্ছি।
উঠে দ্রুত পায়ে মায়ের রুমের দিকে চলে গেল সুমি।
সুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর মনজুও উঠল। উঠে মাসুদ সাহেবের ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার দুর্ভাগ্য আপনার সঙ্গে আমার দেখা হলো না। স্বপ্ন ছিল, আমার বাবাকে যিনি বাঁচিয়েছেন, পায়ে হাত দিয়ে তাকে একবার সালাম করব। আমার কৃতজ্ঞতা জানাব। সেদিন যদি আমার বাবাকে আপনি না বাঁচাতেন, আমার তাহলে এই পৃথিবীতে আসা হতো না। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়া হতো না।
ঠিক তখুনি ডাইনিংস্পেসে টেলিফোন বাজল। পারু টেলিফোন ধরলেন। হ্যালো। জ্বী। হা হা বলুন। আমি সুমির মা। ওয়ালাইকুম সালাম।
ড্রয়িংরুম থেকে মনজু সব শুনতে পাচ্ছিল।
পারু বললেন, ও মকবুল সাহেব। জ্বী জ্বী চিনেছি। আপনার ওখান। থেকে এসে সুমি আমাকে সব বলেছে। কী? সাতদিনের মধ্যে জানাবে বলেছে? না না সাতদিনের দরকার নেই। আপনি এখনই শুনুন। বাড়ি আপনিই নিয়ে নেবেন। আপনার পাওনা টাকা রেখে বাকিটা আমাদেরকে দিয়ে দেবেন। দু একদিনের মধ্যেই সুমি এবং তার জামাইকে আমি আপনার ওখানে পাঠাব। ওরা সব ফাইনাল করে আসবে। জ্বী না, এখনও বিয়ে হয়নি। এনগেজম্যান্ট হয়েছে, বিয়ের ডেট হয়েছে। জ্বী আচ্ছা।
ড্রয়িংরুম থেকে সব কথাই শুনেছে মনজু। শুনে কী রকম স্তব্ধ হয়ে আছে।
এসময় ট্রেতে চা এবং ডালপুরি নিয়ে সুমি এল। যখন সেন্টারটেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখছে সুমি তার হাতের এনগেজম্যান্ট রিংটা দেখতে পেল মনজু। তখনও আগের মতোই স্তব্ধ, আনমনা ভাব তার।
সুমি বলল, এই আপনার ওরকম চা আর ডালপুরি।
মনজু কথা বলল না।
সুমি অবাক হলো। কী হয়েছে?
মনটা একটু খারাপ।
কেন?
আপনার হাতের আংটি দেখে।
সুমি ভুরু কুঁচকালো। আমার আংটি দেখে আপনার মন কেন খারাপ হবে?
না মানে বুঝে গেছি আমার কোনও সম্ভাবনা নেই।
জ্বী?
মনজু হাসল। সিনেমা নাটকে তো এমনই হয়। বাবার বন্ধুর ছেলেতে মেয়েতে ….। হয় না?
সুমিও হাসল। আপনি খুব মজা করে কথা বলেন।
যত মজাই করি কিন্তু আপনার আমার কোনও সম্ভাবনা নেই।
তারপর একটু থেমে বলল, রাগ করলেন নাকি? না না রাগ করবেন না। মনের কথা মনে আমি লুকিয়ে রাখতে পারি না। বলে ফেলি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।
সুমি হাসল। চা এবং ডালপুরি দুটোই ঠাণ্ডা হচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে বসল মনজু। একটা ডালপুড়ি নিয়ে কামড় দিল, সঙ্গে এক চুমুক চা। এবং খেয়ে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। আহা, সত্যি অতুলনীয় খাবার। বাবার মুখে কত টুকটাক বাঙালি খাবারের কথা যে শুনেছি। এবার
একে একে সব খেয়ে যাব।
আবার ডালপুরিতে কামড় দিল মনজু। চায়ে চুমুক দিল। আচ্ছা, কচুরলতি, গাঠি, কচুরমুখি এসব আপনি চেনেন?
সুমি অবাক হলো। ওমা, চিনব না কেন?
ওসবের যত রকমের আইটেম করা যায়, করে আমাকে একদিন খাওয়াবেন তো!
তারপর আবার নির্মল মুখ করে হাসল মনজু। সীমা লংঘন করছি না তো?
কী রকম?
মানে প্রথম দিনই এত অধিকার নিয়ে কথা বলছি! আসলে আপনাদেরকে আমি খুব আপন মনে করছি। আমার নিজের মানুষ মনে করছি। যতদিন দেশে আছি ঘুরে ফিরে আপনাদের এখানে আমি আসব। বিরক্ত হলেও আসব।
কথা বলতে বলতে দুটো ডালপুরি এবং এক কাপ চা শেষ করেছে। মনজু। এবার উঠে দাঁড়াল।
তাকে দাঁড়াতে দেখে সুমি বলল, আমরা কখনই বিরক্ত হবে না। আপনি আসবেন।
তারপর আচমকা মনজু বলল, ভদ্রলোক কী করেন?
কোন ভদ্রলোক?
মানে আপনার যার সঙ্গে হবে।
সুমি হাসল। ও।
আপনি তো আমার চে’ ছোট হবেন, ছোটবোনের জামাইকে কি দুলাভাই বলা যায়? আচ্ছা, বললেই বা কী হয়!
সুমি আবার হাসল। না কিছুই হয় না। ইচ্ছে করলেই বলা যায়। তবে তার আগে ছোটবোনটিকে তুমি করে বলতে হয়?