সেলিমের অফিসে ফোন করল সুমি।
সব শুনে সেলিম বলল, তোমার মায়ের খুব অভিমান হয়েছে। এটা খুব অস্বাভাবিক নয়। এতবড় একটা ব্যাপার যেহেতু তার কাছে তোমার বাবা লুকিয়ে গেছেন, অভিমান তার হতেই পারে।
সুমি বলল, এখন এরকম অভিমানের কোনও মানে নেই। যে মানুষ চলে গেছেন তার ওপর অভিমান করে কী হবে!
তবু অভিমান অভিমানই।
এই ধরনের অভিমানকে আমার ছেলেমানুষি মনে হয়।
সেলিম চুপ করে রইল।
সুমি বলল, কিন্তু আমি কী ডিসিসান নিই বল তো?
আমি কী বলতে পারি, বল!
সুমি কেমন বিরক্ত হলো। কী বলবে মানে? আমার সমস্যাটা শেয়ার করবে না? হেলপ করবে না আমাকে?
অবশ্যই।
বল তাহলে কী করা উচিত আমার!
অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, বাড়ি বিক্রি ছাড়া তো কোনও উপায় দেখছি না।
ঠিকই বলেছ।
আর মকবুল সাহেবের কাছে বিক্রি করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
আমারও তাই মনে হয়।
এবং আর একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, ভদ্রলোক তোমাদেরকে ঠকাবেন না।
এটা আমিও মনে করি। কারণ তিনি লোক ভাল। তবে হানড্রেট পার্সেন্ট ব্যবসায়ি।
তা তো কেউ কেউ হতেই পারেন।
সেলিম একটু থামল। আর দু একটা কথা বলব?
বল।
বিয়েটা ডেট মতোই হওয়া উচিত আমাদের।
কেন?
আমি দু একটা জায়গায় বলে রেখেছি, রেজাল্ট বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি হয়ে যাবে তোমার। তুমি যা বেতন পাবে, পুরো টাকাটা তুমি তোমার মাকে দিতে পারবে। আমাদের সংসারে একটি পয়সাও তোমাকে খরচ করতে হবে না। তারপর আমি আছি, আমিও তোমার মা এবং ভাইকে দেখব।
সেলিমের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল সুমি। বলল, খুব ভাল লাগল তোমার কথা শুনে। মনটা ভাল হয়ে গেল।
তখুনি কলিংবেল বাজল।
সুমি বলল, কে যে এল। রাখি এখন। পরে কথা বলব।
ঠিক আছে।
টেলিফোন রেখে ছুটে গিয়ে গেট খুলল সুমি। খুলে থতমত খেল।
ঝকঝকে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে গেটের বাইরে। ধপধপে সাদা টিশার্ট আর আকাশি রংয়ের জিনস পরা। চোখে সানগ্লাস। পায়ে বুট। গা
থেকে সুন্দর পারফিউমের গন্ধ আসছে।
সুমিকে দেখেই সানগ্লাসটা খুলল সে। মিষ্টি হেসে বলল, হাই।
তারপরই যেন নিজেকে সামলালো। দুঃখিত। স্লামালেকুম।
আপনি …….?
আগে বলুন, এটা মাসুদ সাহেবের বাড়ি তো?
জ্বী।
সঙ্গে সঙ্গে কী যে খুশি হলো যুবক! মুহূর্তে উজ্জ্বল মুখ আরও উজ্জ্বল হয়ে গল তার। থ্যাংকস গড। খুব সহজেই পেয়ে গেলাম। তিনি আছেন?
সুমির মুখ ম্লান হয়ে গেল। গভীর দুঃখের ছায়ায় আচ্ছন্ন হলো মুখ।
ব্যাপারটা খেয়াল করল যুবক। চিন্তিত গলায় বলল, কী হয়েছে?
বাবা, বাবা গত মাসের একুশ তারিখে, সিভিয়ার হার্টএটাক…
কথা শেষ করতে পারল না সুমি। জলে চোখ ভরে এল। চোখের জল সামলাতে অন্যদিকে মুখ ফেরাল সে।
যুবক ততোক্ষণে একেবারেই নিভে গেছে। কোনও রকমে সে শুধু বলল, ওহ, গড!
সুমি আবার তার দিকে তাকাল। কিন্তু আপনাকে ঠিক …….।
না না চিনবার কথা নয়। আমার নাম মনজু। মনজুর রহমান। নিউইয়র্কে থাকি। আচ্ছা, আপনার মা বাড়িতে আছেন? আমি কি তাঁর সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?
আসুন।
সুমির পিছু পিছু তাদের ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকল মনজু।
সুমি বলল, আপনি বসুন। আমি মাকে ডাকছি।
জ্বী আচ্ছা।
মিনিটখানেকের মধ্যে পারুকে নিয়ে এই রুমে ফিরে এল সুমি। এই আমার মা।
সঙ্গে সঙ্গে মনজু তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। কেমন আছেন আপনি?
পারু বললেন, এই অবস্থায় কেমন থাকা যায় বলো? কিন্তু বাবা …..।
আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলবেন আসলে কেমন করে যে পরিচয়টা দেব? আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা।
কী নাম তার?
আপনি বোধহয় তাকে চিনবেন না। তাছাড়া এতকাল আগের ঘটনা।
তবু নামটা বল।
আতিকুর রহমান। মাসুদ চাচা এবং বাবা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে সুমি কেমন উত্তেজিত হলো। গোয়ালিমান্দ্রার যুদ্ধে গুলিতে একটা পা …। হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা আমাকে একদিন তার কথা বলেছিলেন।
সুমির দিকে তাকাল মনজু। তাহলে তো আপনার জানার কথা। গুলিতে ডানপাটা একেবারেই শেষ হয়ে গিয়েছিল বাবার। পাকিস্তানিদের আক্রমণে নতুন করে সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য পিছু হটছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। বাবার দিকে ফিরে তাকাবার সময় ছিল না কারও। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাসুদ চাচা আমার মৃতপ্রায় বাবাকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আমার। বাবার জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন।
সুমি বলল, সেই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারাই জয়ী হন। একটি পাকিস্তানিও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
পারু বললেন, তোমার বাবা বেঁচে আছেন?
জ্বী আছেন এবং শরীরও খুব ভাল তাঁর।
কোথায় আছেন?
নিউইয়র্কে। স্বাধীনতার পর পর ট্রিটম্যান্টের জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। সেই সময়ও বাবাকে পাঠাবার জন্য মাসুদ চাচা অনেক চেষ্টা তদবির করেছিলেন। সব মিলে আমার বাবার জীবনে মাসুদ চাচার ভূমিকার কোনও তুলনা হয় না।
সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পা কি পুরোপুরি ভাল হয়ে গিয়েছিল তার?
না। কেটে বাদ দিতে হয়েছে। বাবা ক্রাচে ভর দিয়ে চলেন। তবে বাবার পায়ের অভাবটা পূরণ করে দিয়েছেন আমার মা।
পারু বললেন, তোমার মা কোথাকার মানুষ?
আমেরিকান বাঙালি। ওখানেই জন্মেছেন।
ও।
তারপর পারু বললেন, তুমি চা খাবে তো, বাবা?
জ্বী না।
সুমি বলল, আপনার মায়ের কথা বলুন।
মা ছিলেন নার্স। ট্রিটম্যান্টের জন্য যে হাসপাতালে ছিলেন বাবা, সেই হাসপাতালের নার্স। পরে বাবার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বাবা আমেরিকাতেই থেকে গেলেন।