এদিকে মেয়েকে এতক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলতে দেখে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন পারু। সুমির কথায় ব্যাপারটা তিনি আঁচ করেছেন। এখন তাকে ফোন ধরে পাথর হয়ে থাকতে দেখে ভাঙাচোরা গলায় বললেন, ফোন ধরে দাঁড়িয়ে কী লাভ? নামিয়ে রাখ।
সুমি অসহায় ভঙ্গিতে ফোন নামিয়ে রাখল।
পারু বললেন, যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। কিন্তু দুঃখ একটাই, আমার কাছে কেন তিনি এসব লুকিয়ে গেছেন? আর এতগুলো টাকা এনেই বা কী করেছেন?
সুমি আগের মতোই অসহায় গলায় বলল, তুমি যেটাকে বাবার রোজগার মনে করেছিলে ওটা রোজগার ছিল না মা। ইন্টারেস্টে টাকা এনে সংসার চালিয়েছেন বাবা। টেলিফোন, কম্পিউটার সব ওই টাকার। বইয়ের দোকানে লস হয়েছিল। সব ওই টাকা থেকে ম্যানেজ করেছেন।
কোন ফাঁকে চোখ ভেঙে কান্না নেমেছে পারুর। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, আজ মনে হচ্ছে তিনি একা মারা যাননি, আমাদেরকেও
মেরে রেখে গেছেন।
পারু আর দাঁড়ালেন না। চোখ মুছতে মুছতে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন।
সুমি তখন একেবারে স্তব্ধ হয়ে আছে।
.
১১.
বেচারাম দেউড়ির গলির ভেতর মকবুল সাহেবের পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। এই বাড়ির নীচতলার একটি রুমে তাঁর অফিস।
অফিস মানে নিজের বসার জন্য চেয়ার টেবিল, লোকজনের জন্য টেবিলের সামনে তিনটে হাতছাড়া চেয়ার আর একসেট গাবদা গোবদা সোফা। আদ্যিকালের কালো ভারি ধরনের একটা টেলিফোন সেট আছে টেবিলের ওপর। আজকাল এরকম টেলিফোন সেট আর দেখা যায় না।
মকবুল সাহেবের টেবিলের সামনে বসে এই টেলিফোন সেটের দিকে তাকিয়ে আছে সুমি। সকালবেলাই এই অফিসে চলে এসেছে সে।
মকবুল সাহেব বললেন, এক কাপ চা খাও মা?
সুমি বলল, জ্বী না, এখন খাব না।
আমারই অবশ্য ভুল হলো।
সুমি চোখ তুলে তাকাল।
মকবুল সাহেব বললেন, জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল তুমি নাশতা করেছ। কী না! তা না জিজ্ঞেস করে চায়ের কথা বললাম।
সুমি মাথা নীচু করল। আমি নাশতা করে বেরিয়েছি।
তাহলে খাও এক কাপ চা।
না। নাশতার সঙ্গে চাও খেয়েছি। বেশি চা খাওয়ার অভ্যেস আমার নেই।
মকবুল সাহেব ভদ্রলোক বেশ অমায়িক ধরনের। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা, মুখে কাঁচাপাকা বেশ ঘনদাড়ি। তবে দাড়ি তেমন লম্বা নয়। মাঝারি মতো, সুন্দর করে ছাটা। মাথায় সাদা একখানা টুপি আছে। মুখটা মায়াবি ধরনের।
এই মুখ আরও মায়াবি করে তিনি বললেন, আমি বুঝেছিলাম তোমার মা আসবেন না। তিনি নিশ্চয় খুব দুঃখ পেয়েছেন।
সুমি উদাস গলায় বলল, জ্বী।
মকবুল সাহেব কথা বললেন না। ড্রয়ার থেকে একটা ফাঁইল আর লম্বা ধরনের মোটা একটা খাতা বের করলেন। ফাঁইলটা সুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই তোমাদের দলিলের ফাঁইল।
ফাঁইলটা ধরল না সুমি। মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে দেখল। ফাঁইলের ওপর বাবার হাতের লেখাটা ফুটে আছে। দেখে সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সেই দীর্ঘশ্বাস টের পেলেন না মকবুল সাহেব। লম্বা মোটা খাতাটা খুলে পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলেন। তারপর একটা পৃষ্ঠায় এসে থামলেন। খাতাটা সুমির দিকে এগিয়ে দিলেন। আর এই যে দেখ তোমার বাবা সই করে টাকা নিয়েছেন।
অপলক চোখে বাবার সই করা পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে রইল সুমি। তারপর আগের মতোই উদাস গলায় বলল, আপনি যে মিথ্যে বলেননি তা আমি জানি।
না না মিথ্যে বলব কেন? মিথ্যে বলা, ছল চাতুরি এসব আমি কোনওদিন করিনি, করবও না। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। তোমাদের ওইটুকু সম্পত্তির জন্য মিথ্যে বলার কোনও দরকার আমার নেই।
জ্বী তাতো বটেই।
তবে মা, আমি ব্যবসায়ি মানুষ। টাকা খাঁটিয়ে টাকা রোজগার করি। এক্ষেত্রে আমার কোনও কম্প্রোমাইজ নেই।
অপলক চোখে মকবুল সাহেবের মুখের দিকে তাকাল সুমি। আমরা তাহলে কী করব এখন?
কী করবে মা, তা আমি কী করে বলব!
না মানে আপনার সাজেসান চাচ্ছি। আমাদের অবস্থা তো আপনি জানেনই, এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত আমাদের?
বলব?
জ্বী বলুন।
আমার কথা আবার অন্যভাবে নেবে না তো?
না না, প্রশ্নই ওঠে না।
বুদ্ধিমানের কাজ হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার টাকাটা শোধ করে দেয়া। নয়তো যতদিন যাবে ইন্টারেস্ট বাড়বে, এবং চক্রবৃদ্ধি হারে। তাতে তোমাদের আরও ক্ষতি হবে। তুমি কী মা চক্রবৃদ্ধি হার জিনিসটা বোঝ?
জ্বী বুঝি।
তাহলে তো তোমাকে আর বোঝাবার কিছু নেই।
জ্বী।
তবে মা, এক্ষেত্রে একটা হেলপ অবশ্য তোমাদেরকে আমি করতে পারি।
বাড়িটা আপনিই নিয়ে নেবেন। আপনার টাকা এডজাস্ট করে বাকিটা আমাদেরকে …..।
কারেক্ট। বাহ তুমি তো খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে। বলবার আগেই সব বুঝে যাও। হ্যাঁ, এটা করাই তোমাদের জন্য সব চাইতে ভাল হবে।
আমি তাহলে আমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করি।
অবশ্যই অবশ্যই। তবে যাই কর, তাড়াতাড়ি করো। কারণ যতদিন যাবে, ওই যে চক্রবৃদ্ধি হার।
সুমি উঠল। না না দেরি করব না। দিন সাতেকের মধ্যে আপনাকে আমি জানাব।
মকবুল সাহেবও উঠলেন। ঠিক আছে মা, ঠিক আছে।
.
১১.
পারু নির্বিকার গলায় বললেন, আমার মতামতের কোনও দরকার নেই। তুই যা ভাল বুঝিস কর।
সুমি কাতর গলায় বলল, সবকিছু আমার ওপর চাপাচ্ছ কেন?
যেহেতু আমার কিছু বলার নেই, কিছু করার নেই। এজন্যই চাপাচ্ছি।
ডাইনিংস্পেস থেকে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেলেন পারু।
সুমির তখন এত অসহায় লাগছে! কী করবে কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে তার। এই অবস্থায় সুমি কি একটু সেলিমের সঙ্গে কথা বলবে!