অন্ধকার বারান্দায় চুপচাপ বসে আছেন। সুমি যাচ্ছিল মায়ের রুমের দিকে। বারান্দাটা অন্ধকার দেখে সুইচ টিপে লাইট জ্বাললো। জ্বেলেই চমকে উঠল। এ কি? তুমি এখানে অন্ধকারে বসে আছ কেন?
পারু উদাস গলায় বললেন, এমনি।
এই বারান্দায় দুতিনটি ভাঙাচোরা বেতের চেয়ার আছে। একটায় বসে আছেন পারু, তার পাশের চেয়ারটায় বসল সুমি। তোমার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু ওসব নিয়ে এখন আর কথা বলে লাভ নেই। আমার এক বান্ধবীর বাবা আছেন উকিল। দলিলপত্র হারিয়ে গেলে কী করতে হয় তাঁর সঙ্গে আলাপ করে আমি জেনে নেব।
পারু কথা বললেন না।
সুমি বলল, আমি তোমাকে অন্য একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
কী কথা?
তুমি হঠাৎ বাড়ির দলিল খুঁজতে শুরু করেছিলে কেন?
পারু গম্ভীর গলায় বললেন, বাড়ি বিক্রি করে ফেলব।
সুমি যেন আকাশ থেকে পড়ল। কী?
হ্যাঁ। এছাড়া বাঁচার উপায় নেই। গেন্ডারিয়ার সবচাইতে কমদামী এলাকায় দেড়কাঠার ওপর এই বাড়ি। আট ন’লাখ টাকার বেশি বিক্রি করা যাবে না। এই টাকা থেকে তোর বিয়ে দেব।
তারপর?
বাকি টাকা ব্যাংকে রাখব। পারিবারিক সঞ্চয়পত্র আছে, সেটা কিনব। তাতে যা ইন্টারেস্ট আসবে, আমার আর অমির চলে যাবে।
তোমরা থাকবে কোথায়? বাসা ভাড়া নেব।
কী?
হ্যাঁ। দেড় দুহাজার টাকায় ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নেব। তাছাড়া অমি টিউশনি করবে। কিছু টাকা সেও রোজগার করবে। অমির পড়াশুনো শেষ হলে আমার আর চিন্তা কী? অমি চাকরি বাকরি করবে, দিন চলে যাবে।
পারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
মায়ের দীর্ঘশ্বাসটা যেন বুকে এসে লাগল সুমির। মন খারাপ করা গলায় বলল, তারচে’ আমার বিয়ের চিন্তাটা যদি বাদ দাও।
চমকে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন পারু। মানে?
এই অবস্থায় বিয়ের চিন্তা বাদ দেয়াই ভাল মা। আমি এমএ পরীক্ষা দিয়েছি, কিছুদিনের মধ্যেই রেজাল্ট বেরুবে। চেষ্টা করলে ভাল একটা চাকরিও পাব। আমি একা চাকরি করে তোমাদের দুজনকে নিয়ে ভালই চলতে পারব। তারপর অমি যখন দাঁড়িয়ে যাবে তখন না হয়….।
সুমির কথা শেষ হওয়ার আগেই পারু বললেন, তখন আর বিয়ের বয়স থাকবে না।
না থাক।
ভাল পাত্রও পাওয়া যাবে না।
না যাক।
না না এসব কোনও কথা নয়। সেলিমের সঙ্গে সব ঠিকঠাক হয়ে আছে। তোর বাবাই করে গেছেন সব।
তাতে কী?
না না এ হবে না।
কেন হবে না মা?
নিজেদের সুবিধার জন্য তোর জীবন আমি নষ্ট করতে পারব না।
তোমাদের জীবন নষ্ট করে আমার জীবন ভাল করবার দরকার কী?
এসব কথা বাদ দে। সেলিমের সঙ্গে বিয়ে তোর ডেট মতোই হবে। আমি যা প্লান করেছি তাই করব।
সুমি কাতর গলায় বলল, এটা ঠিক হবে না মা।
পারু দৃঢ় গলায় বললেন, অবশ্যই ঠিক হবে। তুই ওই উকিল সাহেবের সঙ্গে কথা বলে দলিলের কপি তোলার চেষ্টা কর।
ওসবের জন্য তো টাকা লাগবে মা।
টাকা দেয়া যাবে।
কোত্থেকে?
টেলিফোন বিক্রির টাকা থেকে।
পারু টেলিফোন শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ডাইনিংস্পেসের সামনে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠল।
একবার।
দুবার।
পারু উঠছেন না দেখে সুমি গিয়ে ফোন ধরল। হ্যালো, স্লামালেকুম।
ওপাশ থেকে ভারি ধরনের পুরুষকণ্ঠ ভেসে এল। ওয়ালাইকুম সালাম। সালামের ভঙ্গিতেই বুঝেছি তুমি মাসুদ সাহেবের মেয়ে। ভাল আছ মা?
ভদ্রলোকের কথা বলার ধরন অমায়িক। ভাল লাগল সুমির। বলল, জ্বী আছি। কিন্তু আপনাকে ঠিক….।
আমাকে তোমার চেনার কথা না মা। আমার নাম মকবুল। জায়গা জমি বাড়িঘর এসব কেনা বেচার বিজনেস করি। তোমার বাবার সঙ্গে খুবই চেনা জানা ছিল কিন্তু যাওয়া আসাটা তেমন ছিল না।
জায়গা জমি কেনাবেচা কথাটা শুনেই বুকটা ধ্বক করে উঠেছে সুমির। কিছু একটা বলতে যাবে সে তার আগেই মকবুল সাহেব বললেন, তোমার বাবা মারা গেছেন জানি। কয়েকদিন ধরেই ভাবছি ফোন করব। তারপরে ভাবলাম, থাক, কয়েকদিন পরেই করি। শোকটা তোমরা একটু সামলে ওঠ। এখন তোমাদের মনের অবস্থা কেমন মা?
সুমি বলল, এই আর কী! সবাই মিলে সামলে ওঠার চেষ্টা করছি।
তাহলে তো মা কাজের কথাটা আমি বলতে পারি।
জ্বী বলুন।
তোমরা কি মা জানো যে তোমার বাবা বাড়ির দলিল রেখে গত দেড় বছরে আমার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে লাখ তিনেক টাকা নিয়েছেন?
শুনে সুমি একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। না, না তো!
হ্যাঁ মা। প্রতিলাখে মাসে চারহাজার টাকা ইন্টারেস্ট। সবমিলে অংকটা মা প্রায় সাড়ে চারলাখে দাঁড়িয়েছে।
সুমি কোনও রকমে বলল, ও।
মকবুল সাহেব বললেন, তিনি আমাকে রিকোয়েস্ট করেছিলেন তোমাদেরকে আমি যেন এসব না জানাই।
বুঝলাম। কিন্তু টাকা তিনি কীভাবে শোধ করবেন বলেননি?
তাতো বলেছেনই।
কীভাবে?
বাড়ি বিক্রি করে।
জ্বী?
হ্যাঁ মা।
কিন্তু বাড়ি বিক্রির কথা বাবার মুখে কখনও শুনিনি।
তাই নাকি?
জ্বী। কখনও ভাবতেও দেখিনি।
আমাকে অবশ্য বলেছিলেন আমিই যেন বাড়িটা নিয়ে নেই। বাজারে যে হিসেবে দাম আছে সেই দামে নিয়ে, নিজের টাকাটা কেটে রেখে বাকি টাকা দিয়ে দেব। আমি মা এখনও সেই শর্তে রাজি আছি। তুমি একটা কাজ কর মা, তোমার মাকে নিয়ে যে কোনওদিন আমার এখানে আস। কীভাবে কী করা যায় আমরা আলোচনা করি।
জ্বী আচ্ছা।
তাহলে আজ রাখি মা।
সুমি মৃতের গলায় বলল, জ্বী আচ্ছা।
মকবুল সাহেব ফোন নামিয়ে রাখলেন। কিন্তু সুমি তখনও ফোন ধরে রেখেছে। সে যেন এখন আর মানুষ নয়, সে যেন এখন এক পাথর।