- বইয়ের নামঃ এসো
- লেখকের নামঃ ইমদাদুল হক মিলন
- বিভাগসমূহঃ ছোট গল্প
এসো
এসো – ইমদাদুল হক মিলন
প্রথম প্রকাশ – বইমেলা ২০০১
০১.
বিকেলবেলার আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদছিল সুমি।
এমন নিঃশব্দ কান্নাও কাঁদে মানুষ! চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে, বুকের ভেতর চাপ ধরা কষ্ট, তবু কান্নায় কোনও শব্দ নেই। যেন সুমি কোনও রক্ত মাংসের মানুষ নয়, সুমি এক কলের পুতুল। চাবি দিলে যে পুতুল কেবল কাঁদে। চোখের জলে কেবলই বুক ভাসায়।
বাবার মৃত্যুর পর থেকে বিকেলের দিকটায় এভাবেই কাঁদে সুমি।
এসময়কার বিকেলের আকাশ কী রকম দুখজাগানিয়া। ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে বুকের ভেতর উথলে উঠে প্রিয়জন হারানো হাহাকার।
মৃত্যুর পর কোথায় চলে যায় মানুষ!
ওই আকাশে!
সুমি যখন কঁদছে অমি তখন তার রুমে। অমির হতদরিদ্র রুমে একটাই চোখে পড়ার মতো জিনিস। কম্পিউটার। পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে অমি সেই কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। মনজুড়ে অমিরও চলছে বাবার জন্য হাহাকার। নিজের অজান্তেই যেন কম্পিউটার স্ক্রিনে অমি এক সময় লিখল, বাবা, এভাবে কেন মরে গেলে!
তারপর সেই লেখার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল অমি।
যে মানুষটার জন্য এভাবে কাঁদছে দুজন মানুষ, এ বাড়ির ড্রয়িংরুমে তাঁর একটি বাঁধানো ছবি আছে। টেন টুয়েলভ সাইজের ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ছবি। ছবিটি একাত্তর সালের। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন করে, ঢাকায় ফিরে লক্ষ্মীবাজারের কালাম স্টুডিওতে গিয়ে তুলেছিলেন ছবিটা। তখনও অস্ত্র জমা দেননি মুক্তিযোদ্ধারা। কাঁধে ছিল তাঁর স্টেনগান।
বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার মাথায় তখন লম্বা চুল, মুখময় দাড়ি গোঁফ। গোলা বারুদের ঝাঁজে টকটকে লাল চোখ কারও কারও, যুদ্ধের ক্লান্তি শরীরময়। তারপরও অসম্ভব উজ্জ্বল মুখ একেকজনের। এই ঔজ্জ্বল্য যুদ্ধ জয়ের। স্বাধীনতার।
মাসুদ সাহেবের মুখেও আছে সেই প্রখর ঔজ্জ্বল্য। স্বাধীনতার পর ঊনত্রিশ বছর কেটে গেছে, সেই ঔজ্জ্বল্য একটুও ম্লান হয়নি। ছবির দিকে তাকালে এখনও সেদিনকার মানুষটিকে পরিষ্কার দেখা যায়। ছবিতে আছেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি আর কোথাও নেই।
আজ বিকেলে স্বামীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাটাই মনে হলো পারুর। ছবিতেই আছেন মাসুদ সাহেব, স্মৃতিতে আছেন, বাস্তবে কোথাও নেই।
একথা ভেবে ছেলে এবং মেয়ের মতো পারুও কেঁদে ফেললেন। অদূরের ভাঙা সোফায় যে সেলিম বসে আছে সে কথা মনেই হলো না তার।
কিন্তু পারুকে চোখ মুছতে দেখে উঠে দাঁড়াল সেলিম। তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল।
সেলিমের স্বভাব হচ্ছে কথা শুরুর আগে মৃদু একটা গলা খাকারি দেয়া।
এখনও দিল। দিয়ে বলল, আপনিও যদি এভাবে কান্নাকাটি করেন তাহলে সুমি অমিকে সামলাবে কে? এভাবে ভেঙে পড়া ঠিক হচ্ছে না।
সেলিমের কথাটা যেন শুনতেই পেলেন না পারু। তবে পাশে সেলিমকে দেখে আঁচলে চোখ মুছলেন। ধরা গলায় বললেন, এই ছবিটা তাঁর খুব প্রিয় ছিল। ছবিটার দিকে কখনও কখনও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতেন। বলতেন, আমার জীবনের সবচে বড় অহংকার, আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি।
সেলিম বিনীত গলায় বলল, এসব কথা এখন থাক।
এবারও তার কথা যেন শুনতে পেলেন না পারু। আগের মতো করেই বললেন, সারাটা জীবন তাকে যুদ্ধ করেই যেতে হলো। আজকালকার দিনে এত সৎ মানুষ হয় না। স্বাধীনতার পর ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারতেন। লাইসেন্স, পারমিট, পাকিস্তানিদের বাড়ি দখল, দোকান, জমি দখল। লক্ষ লক্ষ টাকা কামাবার সুযোগ সে সময় পেয়েছেন। কোনও সুযোগ কখনও নেননি। নিলে আমাদের চেহারা আজ অন্যরকম থাকত। এত নিঃস্ব অবস্থায় আমাদেরকে ফেলে, প্রায় বিনা চিকিৎসায় …।
কথা বলতে বলতে শেষদিকে গলা ভেঙে এল পারুর। শব্দ করে কেঁদে ফেললেন তিনি।
পারুর এই অবস্থা দেখে সেলিম একটু দিশেহারা হলো। মৃদু গলা খাকারি দিয়ে বলল, এখন এসব ভেবে আপনি যদি এমন করেন, মানে আপনাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার নেই, তারপরও বলি, আপনি শান্ত না হলে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে।
পারু চোখ মুছতে মুছতে বললেন, শান্ত আমি কেমন করে হই বাবা? আমার অবস্থাটা তুমি একটু ভাব! অন্য সমস্যাগুলো না হয় বাদ দিলাম, তোমার সঙ্গে যে সুমির এনগেজম্যান্ট হয়ে আছে, বিয়ের ডেট হয়ে আছে, এই অবস্থায় মেয়েটিকে আমি বিয়ে দেব কেমন করে!
এই চিন্তাটা আরও কয়েকদিন পরে করুন। মানে আমি বলছিলাম যে সময় তো আছে।
কী এমন সময় আছে? দুআড়াই মাস। চোখের পলকে কেটে যাবে। সুমির বাবা বেঁচে থাকলে কোনও না কোনও ভাবে গরিবী হালে ব্যবস্থা একটা হতোই। তিনি যা পারতেন আমি তো তা পারব না। থাকার মধ্যে এইটুকু একটা বাড়ি। দুপয়সা সাহায্য করার কেউ নেই। তারপরও তুমি আমাকে বল আমি কিছু ভাবব না?
সেলিম মাথা নীচু করল। অবস্থাটা আমি বুঝি। তারপরও আপনাকে এইসব সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আমারই বা কী করার আছে! পড়াশুনো শেষ করে বছর দুয়েক হলো ব্যাংকের এই চাকরিটায় ঢুকেছি। আমরাও মধ্যবিত্ত। ফ্যামিলির অবস্থা তেমন ভাল না।
সেলিমের কথায় পারু একটু লজ্জা পেলেন। না না, তোমাকে আমি কিছু করার কথা বলছি না। আমার মেয়ের সৌভাগ্য যে তোমার মতো ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে। আজকালকার দিনে এমন ছেলে পাওয়া যায় না। তোমার মতো শিক্ষিত, এম বিএ করা ছেলে, ব্যাংকে অত ভাল চাকরি কর, তোমার মতো ছেলেরা বিয়ে করার জন্য বড়লোকের মেয়ে খোঁজে। বড়লোকরাও মেয়ের জন্য তোমার মতো পাত্র খোঁজে। সেখানে তুমি আমাদের মতো একটা ফ্যামিলিতে …….।