পল্টন বাইরে থেকেই দেখল, থানার পুলিসের গাড়ি থেকে চার চারটে ভীষণ চেহারার কুকুর নামানো হল, অনেক নতুন সেপাইও এল আর-একটা গাড়িতে।
খুব ভয়ে-ভয়ে পল্টন গিয়ে থানার ফটকে এক পাহারাওলাকে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে দারোগাসাহেব?”
পাহারাওলা দারোগাসাহেব সম্বোধনে খুশি হয়ে বলল, “বহু বড় বড় চারঠো খুনী ডাকু পকার গয়া।”
কাদামামার জন্য দুশ্চিন্তা আর ঘটোৎকচের মুণ্ডুপাত করতে করতে পল্টন বাড়ি ফিরে গেল।
মাধব পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন শুনে বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে গেল।
অক্ষয় খাজাঞ্চী বলল, “আমি আগেই জানতাম, মাধববাবু একজন ছদ্মবেশী দাগি আসামি। এ-বাড়ির কুটুম সেজে গা ঢাকা দিয়ে আছেন।”
তায়েবজি একবার মিলিটারিতে ঢুকতে গিয়েছিল। কিন্তু পারেনি। মিলিটারির ওপর তার দারুণ শ্রদ্ধা। হরবখত তারা বন্দুক-কামান চালায়। কিন্তু এ-বাড়ির লোক তায়েবজিকে একটা বন্দুকও দেয়নি। বন্দুক ছাড়া দারোয়ানের কোনো ইজ্জত থাকে? তায়েবজি গোঁফ চুমরে বলে, “ও বাত ঠিক নেহি। আসলে মাধববাবু মিলিটারির আদমি। ডিউটিতে কঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তাই ধরা পড়ে গেছেন। মিলিটারি ছাড়া আর কেউ দু’ দুটো বন্দুক রাখে?”
হাঁড়ির মা অবশ্য ঠোঁট উল্টে বলল, “ও মামলা টিকবে না। বন্দুকে গুলিই ছিল না যে!”
পল্টনের মা খবর শুনে কঁদতে বসলেন। বড়বাবু বারান্দায় দ্রুত পায়ে পায়চারি করতে লাগলেন।
এ-বাড়ির লোককে পুলিসে ধরেছে জেনে পল্টনের বাড়ির মাস্টার মশাই পড়াতে এসে এমন ভয় খেয়ে গেলেন যে, একা বাড়িতে ফিরতে সাহস পেলেন না। শেষ পর্যন্ত বাড়ির এক চাকর হারিকেন ধরে তাকে পৌঁছে দিয়ে এল! অনেক রাত পর্যন্ত বাড়ির লোকের ঘুম নেই, খাওয়া নেই। কেবল নানারকম শলাপরামর্শ চলতে লাগল। পাড়া-প্রতিবেশীরাও দলে দলে এসে ভিড় জমাল।
পল্টন গিয়ে ঘন ঘন দেখে আসছে ঘটোৎকচ ফিরে এসেছে কি-না। কিন্তু অনেক রাত পর্যন্তও তার টিকির হদিশ পাওয়া গেল না।
ঘটোৎকচের অবশ্য ফেরার উপায়ও ছিল না।
হল কী, ঘটোৎকচ তো ফুটবল কোলে নিয়ে মহা উৎসাহে গাছের ডালে বসে বসে লেজ দোলাচ্ছে। এদিকে চারটে বিভীষণ কুকুর থানায় ঢুকে ছাড়া পেয়েই বনবন করে চারদিকটা দেখে নিয়েছে। হঠাৎ চারজনই কাঁঠাল গাছের তলায় জড়ো হয়ে ঊর্ধ্বমুখে প্রবল ‘ধ্যাও ঘ্যাও’ আওয়াজ করে চেঁচাতে থাকে।
সেই চিৎকারে থানার যত সেপাই সেখানে এসে জুটল। ব্যাপারটা অদ্ভুত। গাছের ডালে একটা মস্ত বাঁদর বসে আছে, তার কোলে একটা ফুটবল।
জয়পতাকাবাবুর হাত থেকে বল ছিনতাই হওয়ার ঘটনা পুলিস জানে। সেই হারানো বল এত সহজে ফেরত পাওয়া যাবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। এখন কাজ হল, বাঁদরের হাত থেকে বলটা উদ্ধার করা।
নবতারণবাবু শুনেছিলেন, বিলেতে এক টুপিওলা টুপি পাশে রেখে গাছতলায় ঘুমোবার সময় গাছের বাঁদররা তার সব টুপি নিয়ে গাছে উঠে যায়। টুপিওলা ঘুম থেকে উঠে দেখে, বাঁদররা তার সব টুপি মাথায় পরে গাছের ডালে ঠ্যাং দুলিয়ে বসে আছে। কিছুতেই সেই টুপি বাঁদরদের হাত থেকে উদ্ধার করতে না পেরে টুপিওলা রাগ করে নিজের মাথার টুপি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। অমনি বাঁদররাও যে যার মাথার টুপি খুলে দুপদাপ মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
নবতারণবাবু সেই কৌশলটা খাটালেন। হাতের কাছে বল ছিল না। তাই তিনি বলের অভাবে প্রথমে নিজের গোল টুপিটা মাটিতে আছড়ে ফেললেন। কাজ না হওয়ায় পিস্তলটা ছুঁড়ে দিলেন, নস্যির ডিবে মাটিতে আছড়ালেন।
কোনোটাতেই কাজ না হওয়ায় একজন সিপাইকে হুকুম করলেন, “বাজার থেকে এক কাঁদি পাকা মর্তমান কলা নিয়ে এসো।”
কলা এল। গাছের তলায় রাখাও হল। কিন্তু ঘটোৎকচ সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করল না। আপনমনে সে গাছের ডালে বসে বলটা একবার
ছুড়ছে, লুফছে। ছুড়ছে, লুফছে। নীচের দিকে চেয়ে মুখ ভ্যাঙাচ্ছে, গা চুলকোচ্ছে, নিজের পেটে ডুগডুগি বাজাচ্ছে।
সুবিধে হচ্ছে না দেখে সেপাইরা গুলি চালানোর হুকুম চাইল।
নবতারণের একটা হাবাগোবা ছেলে আছে, তার নাম শঙ্কাহরণ। সারাদিন কেবল খাই-খাই আর নানান বায়না। বুদ্ধিশুদ্ধি খুবই কম, তার ওপর ঠাকুমা আর দাদুর আদরে আরো জল-ঘট হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। নবতারণ ভাবছিলেন বাঁদরটা নিয়ে শঙ্কাহরণকে পুষতে দিলে কেমন হয়? শঙ্কাহরণের সঙ্গে পাড়া ও ইস্কুলের ছেলেরা মিশতে চায় না, বরং খেপিয়ে মারে। বোকা আর অলস প্রকৃতির হলে যা হয় আর কী। তা এই বুদ্ধিমান বাঁদরটার সঙ্গে মেশামেশি করলে শঙ্কা হরণের মগজ কিছুটা ধারালো হতে পারে। তাই নবতারণ বললেন, “গুলি নয়, গ্রেফতার। এখন তোরা যে যার কাজে যা। কুকুর গুলোকে পাহারায় রেখে যাস, যেন বাঁদরটা পালাতে না পারে।”
তো তাই হল। চারটে কুকুর গাছতলায় খাপ পেতে বসে রইল পাহারায়। সেপাইরা রোদে গেল।
এদিকে নবতরণ থানার চার্জ নেওয়ায় হাজতের মধ্যে ভারী হতাশ হয়ে বসে আছেন মাধববাবু। জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছেন। বলা যায়। বনমালী তাঁর হাঁটুতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, “অত হাল ছেড়ে দেবেন না কর্তা, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।“
মাধববাবু ধরা গলায় বললেন, “শুনেছি পুলিস ধরলে সহজে ছাড়ে না। খুব মারে, খেতে দেয় না, কুটকুটে কম্বলের বিছানায় শুতে দেয়। অত কষ্ট করার অভ্যাস আমার নেই যে। তাছাড়া যদি যাবজ্জীবনের মেয়াদ বা ফঁসির হুকুম হয়, তখন?”