মাধব হেসে বললেন, “জাতভাই বলে বাঁদরটা তোমাকে চিনতে পেরেছে যে! চেষ্টা করলে ভাষাটা আয়ত্ত করা তেমন শক্ত হবে না তোমার। বাঁদরের আর সব কিছু শিখতে তে বাকি রাখোনি বাপু, ভাষাটা আর কত কঠিন হবে? বলতে-বলতেই মাধববাবুর কী একটা খেয়াল হয়। তিনি একটু থেমে চেঁচিয়ে ওঠেন, “বাঁদরটা কি খুব বড়?”
“বড়ই।” বিষ্ঠু জবাব দেয়।
ঘটোৎ নয় তো? মাধববাবু চিন্তিত মুখে আপনমনে বলতে লাগলেন, “কোলে ফুটবল দেখলে? ব্যাপারটা খুব ঘোরালো ঠেকছে তো। শহরটাই বা থমথম করবে কেন? লাতনপুর হাফটাইমের আগেই তিন গোল দিয়েছে দেখে এসেছি। হাফটাইমের পর আরো তিনটে দেওয়া তাদের কাছে শক্ত নয় মোটেই।”
ঠিক এই সময়ে রাস্তা দিয়ে বিরাট শোরগোল তুলে একটা মিছিল এল। “…ভবতারিণী স্মৃতি শীল্ড জিতল কে? হেতমগড় আবার কে?…হেরে হয়রান হল কে? লাতনপুর, আবার কে?…”
বিড়বিড় করে মাধববাবু বললেন, “আশ্চর্য! পরমাশ্চর্য! পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য!”
বনমালী তার স্যাঙাতদের নিয়ে ঘরের এক কোণে গিয়ে ফিসফিস করে কী পরামর্শ দিচ্ছিল। মাধব মাথায় হাত দিয়ে বসে হাজারো কথা ভাবছিলেন। ভরতারিণী স্মৃতি শীল্ড। বাঁধানো দাঁত। হেতমগড়ের হারানো মোহর। ঘটোৎকচের কোলে ফুটবল। ভাবতে-ভাবতে মাথা ঝিমঝিম করায় একটু ঘুমিয়েও পড়েছিলেন।
হঠাৎ লোহার গেট খুলবার শব্দ হল। ঘরে এসে দাঁড়ালেন থানার নতুন দারোগা নবতরণ ঘোষ। ছ ফুট লম্বা বিভীষণ চেহারা, দুটো চোখ আলুর মতো গোল আর টর্চবাতির মতো জ্বলজ্বলে, হাত দুটো দেখলে মনে হবে ঐ দুই হাতে একটা মোষের মাথা তার ধড় থেকে ছিঁড়ে ফেলতে পারেন। দারোগা হিসেবে নবতারণের সাঘাতিক নামডাক।
নবতারণ মাধবের দিকে চেয়ে বললেন, “আপনার অপরাধ খুবই গুরুতর। পাবলিক প্লেসে আপনি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছেন। সুতরাং কঠিন শাস্তির জন্য তৈরি হোন।”
মাধববাবু বরাবরই পুলিসের ভয়ে আধমরা। দুনিয়ায় আর কোনো-কিছুকে গ্রাহ্য না করলেও কেবল এই পুলিসই তাঁকে কাবু করে রেখেছে। পুলিস দেখলে তার রাতে ঘুম হয় না, খাওয়া কমে যায়, পেটের মধ্যে অনবরত গুড়গুড় করতে থাকে। এখনো করছিল। তাই তিনি ভ্যাবাচ্যাকা মুখে নবতারণের দিকে চেয়ে ছিলেন।
নবতারণ বনমালীর দিকে চেয়ে বললেন, “তোমার হিস্টরিও আমি সব জানি। এ-অঞ্চলের যত চোর ডাকাত আর বদমাশ সব তোমার কাছে ট্রেনিং নেয়। ট্রেনার হিসেবে তুমি খুবই উঁচুদরের সন্দেহ নেই। কিন্তু আমিও অতি উঁচুদরের দারোগা, এটা ভুলে যেও না। তুমি হাজত থেকে ইচ্ছে করলেই পালাতে পারে, তাও আমি জানি। সেইজন্য আমি বিশেষ ব্যবস্থা করে রেখেছি। সদর থেকে চারটে বাঘা কুকুর আনা হয়েছে, তারা দিনরাত থানা পাহারা দেবে। ভাল ট্রেনিং পাওয়া দু ডজন স্পেশাল সেপাইও আনা হয়েছে তোমাদের ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখার জন্য। তাছাড়া আমি তো আছিই। লোকে বলে, আমার নাকি দশ জোড়া চোখ, দশটা হাত আর দশটা মগজ। কাজেই খুব সাবধান!”
এই বলে নবতরণ চলে গেলেন। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
বনমালী কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “কর্তা, ব্যাপারটা খুব সুবিধের ঠেকছে না। কাল অবধি নবতারণ এ-থানায় ছিল না। আজই বদলি হয়ে এসে কাজ হাতে নিয়েছে। ওর মতো ঘুঘু লোক আর নেই।”
মাধব নেতিয়ে বসে ছিলেন। বললেন, “তাহলে কী হবে?”
“এখন তো চুপচাপ থাকুন। দেখা যাক।”
বাইরে এমন সময় গোটা চারেক কুকুরের গম্ভীর গর্জন শোনা গেল। হাঁকডাকেই বোঝা যায়, এরা যেমন-তেমন কুকুর নয়। সেলের সামনে দিয়ে কয়েকজন বিকটাকার লোক ঘোরাফেরা করে গেল। তাদের ছুরির মতো ধারালো চোখ, মুখ খুব গম্ভীর। দেখে-শুনে মাধব আরো ঘাবড়ে গেলেন।
৩. পল্টন পড়েছে মহা ফ্যাসাদে
এদিকে পল্টন পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। ফুটবলের মাঠে যখন প্রাইজ ডিসট্রিবিউশন চলছিল তখনই ঘটোৎকচ এক ফাঁকে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। লাতনপুরের গেম-স্যার জয়পতাকাবাবু একটা ফুটবল হাতে নিয়ে গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঘটোৎকচ সুট করে বলটা হাতিয়ে নিয়েই দৌড়।
তাতে পল্টন খুশিই হয়েছিল। ফালতু একটা ফুটবল পেয়ে যাওয়ায় তার তরুণ সঙ্ঘের বেশ সুবিধেই হবে। কিন্তু মুশকিল হল ঘটোৎকচ কিছুতেই বলটা হাতছাড়া করতে নারাজ। মদনমোহন বাড়ির আমবাগানে ঢুকে দুজনে যখন গা-ঢাকা দিয়েছিল, তখন পল্টন অনেক তোতাই-পাতাই করেছে। কিন্তু নতুন জিনিস হাতে পেয়ে ঘটোৎকচ তাকে বেশি পাত্তা দিতে চায়নি।
যাই হোক, কাদামামাকে থানায় নিয়ে গেছে, সুতরাং ফুটবল নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পল্টনের তখন নেই। সুতরাং সে ফুটবল সহই ঘটোৎকচকে নিয়ে আঁশফলের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে থানামুখো রওনা দিল।
কাদামামাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে কী ভাবে রেখেছে সেটা জানা দরকার। তাই সে ঘটোৎকচকে যতদূর সম্ভব আকারে ইঙ্গিতে ব্যাপারটা বুঝিয়ে ছেড়ে দিল। ফুটবল বগলে নিয়েই ঘটোৎকচ থানার কাছ-বরাবর একটা কদম গাছে উঠে একটা ডাল ধরে ঝুল খেয়ে মস্ত উঁচু দেওয়ালের ওপর নামল। তারপর সেখান থেকে এক লাফে উঠল একটা কাঁঠাল গাছে। সেখানে ফুটবল কোলে করে বসে রইল আপন মনে। কোথায় কাদামামার খবর নেবে তা নয়, কেবল কোলের ফুটবলটা ছুঁড়ে দিয়ে ধরে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে, শোকে।
পল্টন অনেক শিস-টিস দিয়ে ইশারা করল। কোনো কাজ হল না তাতে। এদিকে সন্ধে হয়ে এসেছে। দিনের আলো থাকতে থাকতে বাড়িতে না ঢুকলে বাবা আস্ত রাখবেন না। বাড়ির নিয়ম কানুন ভারী কঠিন।