হেতমগড়ের ক্যাপটেনের হাতে ভবতারিণী স্মৃতি শীল্ড তুলে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, “পশুপাখি যে মানুষের কত উপকারে লাগে, তা বলে শেষ করা যায় না। পশুপাখির কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।” এর পর লাতনপুরের ক্যাপটেনের হাতে রানার্স আপের পুরস্কার তুলে দিয়ে তিনি বললেন, “কিছু কিছু পশুপাখি যে মানুষের কত অপকার সাধন করে তার হিসেব নেই। এইসব অপকারী পশুপাখির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করাটা আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে নিতে হবে।”
দুরকম কথাতেই দর্শক ও শ্রোতারা খুব হাততালি দিল।
ওদিকে থানার লক-আপে চারটে চোরের সঙ্গে এক কুঠুরিতে আবদ্ধ মাধববাবু এতসব খবর জানেন না। দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বুজে বসে আছেন আর হেতমগড়ের হেরে যাওয়ার কথা ভাবছেন। বিকেলে চা খাওয়ার অভ্যাস, কিন্তু লক-আপে চা জোটেনি বলে মাথাটা টিপটিপ করছে। বাঁধানো দাঁত, গামছা ও চটির শোকও
উথলে উঠছে বুকের মধ্যে। সেই সঙ্গে পৈতৃক মোহরের কথা ভেবেও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন।
এমন সময়ে চারজন চোরের মধ্যে একজন একটু সাহস করে বলল, “হেতমগড়ের কুমার-বাহাদুর না?”
মাধববাবু চোখ খুললেন। এতক্ষণ লজ্জায় তিনি এই চারটে লোকের দিকে ভাল করে তাকিয়েও দেখেননি। এখন দেখলেন, চার জনের মধ্যে যে লোকটা সবচেয়ে বুড়ো সেই পাকা চুল আর পাকা দাড়িওলা লোকটা জুলজুল করে তার দিকে চেয়ে আছে। মাধববাবু খানিকক্ষণ লোকটার দিকে চেয়ে ম্লান একটু হেসে বলেন, “তুমি বনমালী! তাই বলে।”
বনমালী ছিল হেতমগড়ে মাধবদের বাড়ির মালি। দারুণ সুন্দর সব ফুল ফোঁটাতে আর ফল ফলাতে তার জুড়ি ছিল না। তবে যাকে বলে ক্লিপটোম্যানিয়াক, বনমালী ছিল তাই। চুরি করা ছিল তার মজ্জাগত কু-অভ্যাস। চুরি করতে না পারলে তার পেট ফাঁপত, আইঢাই হত, রাতে ঘুমোতে পারত না ভাল করে। সোনাদানাই হোক বা সেফটিপিন, নস্যির কৌটো, কাঁচের চুড়ি যাই হোক, কিছু না-কিছু তাকে চুরি করতেই হবে। চুরি করে বড়লোক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল না, কেবল জিনিসগুলি নিয়ে নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখে দিত। তাই বনমালীর চুরিবিদ্যের জন্য তাকে কেউ খারাপ চোখে দেখত না। এমনকী, যাতে সে চুরির অভ্যাস বজায় রাখতে পারে তার জন্য বাড়ির এখানে-সেখানে জিনিসপত্র ফেলে রাখা হত। তারপর তার ঘর থেকে একসময়ে গোপনে সেগুলি উদ্ধার করেও আনা হত।
বনমালী অবাক হয়ে বলে, “আপনাকে কয়েদ করেছে এতবড় সাহস পুলিসের হয় কী করে?”
মাধব ম্লান মুখে বলেন, “সে অনেক কথা। সে সব না তোলাই ভাল। তুমি কেমন আছ বলো!”
বনমালী দুঃখ করে বলল, “হেতমগড় ভেসে যাওয়ার পর আর কাজকর্ম জোটেনি। চেয়েচিন্তে দিন কাটে। গাছপালা ছাড়া থাকতে পারি না বলে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই। আর কিছু লোক চুরিবিতে শিখতে আমার কাছে আসে, তাদের শেখাই। কিন্তু আজকালকার ছ্যাচড়াগুলো এত লোভী যে, বিদ্যেটা ভাল করে না-শিখেই হামলে চুরি করতে যায় আর ধরা পড়ে বে-ইজ্জত হয়। এই দেখুন না, এই তিনটে স্যাঙাতকে বিদ্যেটা সবে শেখাতে শুরু করেছিলাম, তা বাবুদের তর সইল না। ভাল করে না-শিখেই থানার পুকুর থেকে মাছ চুরি করতে গিয়ে ধরা-টা পড়ে একশা। নিজেরা তো ধরা পড়লই, আবার পিঠ বাঁচাতে আমার নামও পুলিসকে বলে দিল। তাই কপালের ফেরে জেলখানায় বসে আছি। কিন্তু ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। হাজতে আটক না থাকলে আপনার সঙ্গে দেখাই হত না।”
মাধব বনমালীকে বহুকাল বাদে দেখে খুশি হলেন। এক সময়ে বনমালীর কোলেপিঠে চড়েই মানুষ হয়েছেন। বললেন, “কথাটা খুব খাঁটি। তবে কিনা হাজতে আসা বা থাকাটা আমার তেমন পছন্দ নয় হে, বনমালী।”
বনমালী এক গাল হেসে বলল, “আপনাকে বেশিক্ষণ হাজতে থাকতে হবে না, কর্তা। সে-ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন।”
তারপর এক রোগা-পাতলা চেহারার স্যাঙাতের দিকে চেয়ে বনমালী হুকুম দিল, “বিষ্ণু, ওঠ।”
বিধুকে এতক্ষণ ভাল করে লক্ষ করেননি মাধব। এবার করলেন এবং একটু অবাক হয়ে গেলেন। বিষ্ণুর হাবভাবের মধ্যে বেশ একটা বাদুরে ভাবভঙ্গি আছে। দাঁড়ানোর সময় একটু কুঁজো হয়ে থাকে, লম্বা রোগা হাত দুখানা সামনের দিকে বুল খায়। মাঝে-মাবে বাঁদরের মতো গা-চুলকানোর স্বভাবও তার আছে। হুকুম পেয়ে সে হাজতঘরের একটা কোণে গিয়ে সমকোণ দুই দেয়ালের খাঁজে দাঁড়াল। তারপর গুরু বনমালীর দিকে ফিরে একটা নমস্কার জানিয়ে দুদিকের দেয়ালে হাত আর পা চেপে টিকটিকির মতো ওপরে উঠে যেতে লাগল। দৃশ্যটা দেখে মাধব হাঁ। ঘটোৎকচেরও যে এমন এলেম নেই!
অনেক ওপরে, ছাদের কাছ বরাবর একটা গরাদ লাগানো ঘুলঘুলি আছে। তা দিয়ে বাইরে সদর রাস্তা পর্যন্ত দেখা যায়। বিষ্ণু ওপরে উঠে সেই ঘুলঘুলি দিয়ে ভাল করে বাইরেটা দেখে নিল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে কী যেন শোনবার চেষ্টা করল। নাক বাড়িয়ে বাতাসটা বোধহয় শুঁকলও একটু। বনমালী মাধবের দিকে চেয়ে বলল, “এ তেমন কোনো কেরানি নয়, কর্তা। এ হল টিকটিকি বিদ্যা। ওস্তাদের ওপর ভক্তি আর বিদ্যে শেখার ‘হাউস’ থাকলে এসব শেখা তেমন কোনো শক্ত কাজ নয়।”
মাধব জবাব দিতে পারলেন না। বিষ্টু খানিকক্ষণ ওপরে থেকে আবার নেমে এল। বলল, “সিপাইরা বেশি নেই। রাস্তাঘাট খুব থমথম করছে। তার মানে আজকের খেলায় লাতনপুর জিততে পারেনি। আর-একটা খুব অবাক কাণ্ড দেখলাম। ঘুলঘুলির ওপাশে একটা কাঁঠাল গাছের ডালে মস্ত একটা বানর বসে আছে, তার কোলে একটা ফুটবল। আমাকে ঘুলঘুলি দিয়ে দেখতে পেয়ে হুপ হুপ করে কী যেন বলল। ভাষাটা ঠিক বুঝলাম না।”