রাইট-উইং থেকে বল চমৎকারভাবে ব্যাক সেন্টার হয়েছে। রাইট ইন বল ধরেই থ করে বলটা এগিয়ে দিল। একেবারে রসগোল্লার মতো সহজ বল। পা ছোঁয়ালেই গোল। তা পা প্রায় চুঁইয়ে ফেলেওছিল লাতনপুরের লেফট-ইন। কিন্তু মুশকিল হল, বলটার নাগাল না পেয়ে। দিব্যি সুন্দর বলটা একটু ধীরগতিতে গড়িয়ে যাচ্ছিল সামনে, লেফট-ইন ছুটে গিয়ে পজিশন নিয়ে শট করতে পাও তুলেছে, ঠিক এই সময়ে একটা অতিকায় বানর কোত্থেকে এসে বলটাকে কোলে তুলে এক লাফে গোলপোস্টের ওপরে উঠে গেল। তারপর লেফট-ইনকে মুখ ভেংচে বলটা মাঠের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তরতর করে নেমে পালিয়ে গেল।
মাঠে কেউ কেউ প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়ল। কেউ রাগে গরগর করতে লাগল। কেউ বলল, “ধর ওটাকে, ধর। রেফারী বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে জড়ো করে বললেন, “এটা একটা ন্যাচারাল ডিসটারবেন। সুতরাং ড্রপ দিয়ে খেলা শুরু হোক।”
লাতনপুর গোল দিতে না পেরে হতাশ, হেতমগড় চতুর্থ গোলের হাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ায় বেশ চাঙ্গা। ফলে ড্রপ দেওয়ার পর হেতমগড়ের খেলোয়াড়রা প্রাণপণ চেষ্টায় লাতনপুরের সীমানার মধ্যে বল নিয়ে ঢুকে পড়ল।
অবশ্য গোল হওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তবু হেতমগড়ের রাইট-উইং মরিয়া হয়ে লাতনপুরের গোলে একটা অত্যন্ত দুর্বল শট নিয়েছিল। শট এতই দুর্বল যে গোলের দিকে যাওয়ার আগে দুবার মাটিতে ড্রপ খেল। লাতনপুরের ব্যাকরা ভাবল, গোল কীপারই বলটা ধরুক। তাই নিজেরা আর গা ঘামাল না। গোলকীপার নিশ্চিতমনে বলটা ধরার জন্য এগিয়ে এসেছিল। এই সময়ে হঠাৎ গোন্সপোস্টের মাথা থেকে ঘটোৎকচ বিকট একটা ‘হুপ’ দিল, তারপর দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড অঙ্গভঙ্গি করে নাচ জুড়ে দিল। সেই সঙ্গে ‘কুক-কুক’ করে বাঁদুরে গান।
গোলকীপার একটা বাচ্চা দুধের ছেলে। বাঁদরের এই বীভৎস নাচ-গান দেখে সে এমনই ঘাবড়ে গেল যে, বলটার কথা তার মনেই রইল না। বলটা তার সামনেই ড্রপ খেয়ে তার হাত ছুঁয়ে প্রায় বগলের তলা দিয়ে খুব অনিচ্ছের সঙ্গে গোলে গিয়ে ঢুকে গেল।
রেফারী গোলের বাঁশি বাজালেন। লাতনপুর প্রতিবাদ জানালে রেফারী বললেন, “বাঁদরটা চেঁচিয়েছে বটে, নাচও দেখিয়েছে, কিন্তু সে তো দর্শকরাও হামেশাই দেখায়। সুতরাং ওতে আইনভঙ্গ হয় না।”
সুতরাং হাফটাইমের পর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফল দাঁড়াল ৩-১। মাঠে এমন হইচই পড়ে গেল যে কান পাতা দায়।
গোল খেয়ে যেমন একটু বোমকে গেল লাতনপুর, গোল দিয়ে তেমনি চুমকে উঠল হেতমগড়। সুতরাং খেলাটা আর এক তরফা রইল না। লাতনপুরের বিখ্যাত হাফব্যাক ফটিক বল ধরে হরিণের মতো দৌড়ে লেফট-ইনকে বল বাড়াল একবার। লেফট-ইন নিখুঁত একটা ভলি গোলে মেরে দিল। হেতমগড়ের গোলকীপার মাটিতে পড়ে আছে, বল জালে ঢুকছে, ঠিক এই সময়ে আবার বাঁদুরে কাণ্ড। ঘটোৎকচ ঝুপ করে যেন আকাশ থেকে দৈব বাঁদরের মতো নামল এবং বলটা পট করে ধরে আবার গোলপোস্টে উঠে গেল। লাতনপুর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গোলের দাবি করতে লাগল। কিন্তু রেফারী কঠিন স্বরে বললেন, “গোলে বল না ঢুকলে গোল দেওয়ার কোনো আইন নেই। সুতরাং আবার ড্রপ দিয়ে খেলা শুরু হল। হেতমগড়ের খেলুড়েরা দারুণ উৎসাহের চোটে বল লেনদেন করতে করতে ঢুকে পড়ল লাতনপুরের এলাকায়। লাতনপুরের গোলকীপার থেকে শুরু করে সব খেলুড়েই বাঁদরাতঙ্কে কণ্টকিত। তারা এই সময়ে বাঁদরের হস্তক্ষেপ আশঙ্কা করে চারদিক চাইছে, সকলেরই দোনো-মোনো ভাব, বাঁদরটা কখন কোন দিক থেকে হানা দেয়। আর এই দোনো-মোনোর ফলেই হেতমগড়ের রাইট লিংকম্যান ষষ্ঠীচরণ মনের সুখে একখানা ফাঁকা জমি ধরে এগিয়ে গিয়ে গুপ করে জোরালো শটে গোল দিয়ে দিল। ফল সেকেণ্ড হাফের পনেরো মিনিটের মধ্যেই খেলার হাওয়া উল্টো দিকে বইতে থাকে। হেতমগড় বুঝতে পেরেছে স্বয়ং সৌভাগ্যই আজ বাঁদরের রূপ ধরে এসে তাদের পক্ষ নিয়েছে। আর লাতনপুর ভুগছে বাঁদরের আতঙ্কে। সুতরাং দ্বিতীয় গোলটার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ষষ্ঠীচরণ আবার এগোল এবং বল পাস করল রাইট-উইংকে। রাইট উইং বল ধরে ধনুকের মতো বাঁকা পথে ছুটতে লাগল হরিণের মতো। ওদিকে গোলপোস্টের মাথায় ঘটোৎকচ উঠে বসে আছে এবং গোলকীপারের নাকের ডগায় নিজের লম্বা লেজটা নামিয়ে দিয়ে খণ্ড ত দেখাচ্ছে। লাতনপুরের গেম-স্যার জয়পতাকাবাবু একটা পোলভল্টের বাঁশ নিয়ে বাঁদরটাকে তাড়া করতে দৌড়োচ্ছন। রাগী ও রাশভারী জয়পতাকা-স্যারকে বাঁশ নিয়ে দৌড়োতে দেখে লাতনপুরের খেলোয়াড়রা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। সেই ফাঁকে রাইট-উইং খুব সহজেই গোলে বল ঢুকিয়ে ফল ৩৩ দাঁড় করিয়ে দিল। রেফারী বাঁশি বাজানোর পর লাতনপুরের খেলোয়াড়রা অবাক হয়ে দেখল, তারা আর-একটা গোল খেয়ে গেছে।
জয়পতাকা-স্যার অবশ্য ঘটোৎকচকে বাঁশপেটা করতে ব্যর্থ হলেন। কারণ ঘটোৎকচ হঠাৎ একটা ডিগবাজি খেয়ে নেমে জয় পতাকাবাবুর ধুতির কাছা এক টানে খুলে ফেলে হাতের বাঁশটা কেড়ে নিয়ে দৌড়। চারদিকে প্রচণ্ড চেঁচামেচি, হাসাহাসি পড়ে যাওয়ায় রাশভারী ও রাগী জয়পতাকা-স্যার নিজের কাছা আঁটতে আঁটতে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “ডিসিপ্লিন! ডিসিপ্লিন!”
খেলা আবার শুরু হল বটে, কিন্তু লাতনপুরের ততক্ষণে সব উৎসাহ নিভে গেছে, দমও ফুরিয়ে এসেছে। খেলায় তার মনোযোগই দিতে পারল না। সুতরাং ঘটোৎকচ আর হানা না দেওয়া সত্ত্বেও হেতমগড় গুনে গুনে আরো দুটো গোল দিল লাতনপুরকে।