কাদা ছেনে পুতুল গড়েন বলেই মাধববাবুর ডাক নাম কাদা। পিসির বড় ছেলে গদাই দৌড়ে গিয়ে মায়ের মুখে হাতচাপা দিয়ে কানে কানে বলে, “অচেনা লোক কী গো! কাদাদাদা যে।”
পিসি তা বুঝল না, তবে এক গাল হেসে ছেলের দিকে চেয়ে বলল, “তুমিও বুঝি ঐ লোকটার সঙ্গে এলে! দেখো বাপু, চুরি-টুরি কোরো না। থাকো, ঘরের কাজকর্ম করে, খাবে দাবে মাইনে পাবে।” বলে পিসি চলে গেল।
নেয়ে-খেয়ে ঘুমিয়ে বিকেলের দিকে একটা বন্দুক বগলদাবা করে মাধববাবু নিজেদের হারানো বসতবাড়ির খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। রাগ হলেই মাধববাবুর এই বাতিকটা মাথায় চাড়া দিয়ে ওঠে।
সত্যি বলতে কী, মাধববাবুর পিতৃ-পিতামহের অবস্থা ছিল বিরাট। সরস্বতী নদীর ওধারে হেতমগড়ে প্রায় দেড়শো বিঘা জমি ঘিরে ছিল তাদের বাড়ির সীমানা। মাঝখানে প্রাসাদের মতো বাড়ি, ফোয়ারা, আস্তাবল, জুড়িগাড়ি, গোলাপ বাগিচা, পদ্মের পুকুর। সরস্বতীর খাত বদল হওয়ায় নদীর ভাঙনে সব ভেসে গেছে। এখন আর সে বাড়ির চিহ্নও নেই। এমনকী, বাড়িটা কোন্ জায়গায় ছিল তারও হদিস কেউ দিতে পারে না। সরস্বতীর ওপারে এখন বিশাল ঘন জঙ্গল, সাপখোপের আড্ডা, বুনো জন্তুর আস্তানা। তবু মাঝে মাঝে মাধববাবু সেই বাড়িটা খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন।
নদীর এধারে আস্তে-আস্তে হাঁটতে-হাঁটতে মাধববাবু নিজের রাগের কথা ভাবছিলেন। আর মাঝে-মাঝে নদীর ওধারে ঘন জঙ্গলের দিকে চেয়ে দেখছিলেন। মধ্যে-মধ্যে হেসেও ফেলছিলেন আপনমনে। জমিদারি রক্তে রাগ থাকাটা এমনিতেই স্বাভাবিক। কিন্তু রহিম শেখের আমবাগান কেনার কথায় হঠাৎ মাথার মধ্যে বেকায়দায় বোমাটা ফেটে যাওয়াতে এখন তার একটু লজ্জা-লজ্জা করছে। কোথায় ঘটোৎকচ, আর কোথায় রহিম শেখ।
মাধববাবুর বাঁধানো দাঁতের কথা শুনে কেউ তাঁকে বুড়ো ভাবলে ভুল হবে। বলতে কী, মাধববাবু রীতিমত যুবক মানুষ। বয়স বত্রিশ টত্রিশ হবে। বছর পাঁচ-সাত আগে বিজয়পুরের জমিদারের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু সে বিয়েটাতেই যত ভণ্ডুল লেগেছিল। বিয়ের পরদিন সকালে শালীরা আদর করে এক থালা নারকেলনাড় এনে দিল। বলল, সব কটা খেতে পারলে বুঝব জামাইবাবু আমাদের বাহাদুর। শালীরা জামাইবাবুকে নানা কায়দায় জব্দ করে জেনেও অকুতোভয় মাধববাবু ঠিক করলেন, এদের কাছে হার মানা চলবে না। প্রথম নাড়টায় কামড় দিয়েই দেখলেন ভিতরে গোটা সুপুরি রয়েছে। কিন্তু এখন আর ফেরার উপায় নেই। দাঁতের জোর ছিল খুব। তাই খটাস মটাস শব্দে সুপুরিসুদ্ধ সেই নাড় চিবোতে লাগলেন। গোটা পাঁচেক খেতে পেরেছিলেন বোধহয়। কিন্তু তা করতে অর্ধেক দাঁতের চলটা উঠে গেল, কিছু নড়ল, কিছু ভাঙল। রাগ করে সেই যে শ্বশুরবাড়ি থেকে একবস্ত্রে চলে এলেন, আর কোনোদিন ওমুখো হননি। দাঁতগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই তুলে বাঁধিয়ে নিতে হল। কিন্তু যুবক হলেও বাঁধানো দাঁতগুলোর অভাবে ফোকলামুখে এখন তাঁকে রীতিমত বুড়ো দেখাচ্ছে। কিন্তু তিনি যে বুড়ো নন সেইটে লোকের কাছে প্রমাণ করার জন্য বুক চিতিয়ে চওড়া ছাতি ফুলিয়ে খুব দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটছিলেন তিনি।
তবে তার দরকার ছিল না। নদীর ধারে একটা লোককে বন্দুক হাতে চলাফেরা করতে দেখে লোকজন ভয়ে এমনিতে তফাত থাকছিল।
বড় বাঁধের ধারে হাইস্কুলের মাঠে আজ ফাঁইনাল ফুটবল ম্যাচ। দারুণ ভিড় চারদিকে। সেই ভিড়ে ছুচ গলবার উপায় নেই। লাতন পুর হাইস্কুলের সঙ্গে হেতমগড় বিদ্যাপীঠের খেলা। খেলা দেখেই মাধববাবুর রক্তটা ঝাঁ করে গরম হয়ে গেল। নিজে তিনি এক সময়ে দুর্দান্ত ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু সেজন্য নয়। আসলে হেতমগড় নামটাই তার রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল। সেই হেতমগড় আজ আর নেই। সরস্বতীর বানে পুরনো হেতমগড় ভেসে গিয়ে আবার নতুন করে হেতমগড়ের পত্তন হয়েছে। তবু হেতমগড় নামটাই যথেষ্ট। এই হেতমগড় বিদ্যাপীঠেই তিনি পড়তেন। তার আমলে বিদ্যাপীঠ কখনো হারেনি।
মাধববাবু ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখেন এমনই ঠাসা ভিড় যে, লোকগুলোকে যেন আঠা দিয়ে এর-ওর গায়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাধববাবুর ধৈর্য কম। ঝাঁ করে বন্দুকের নলটা ভিড়ের ভিতরে সেঁদিয়ে দিয়ে হুংকার ছাড়লেন, “রাস্তা না দিলে গুলি চালাব কিন্তু।”
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই লাতনপুর হেতমগড়কে তিন নম্বর গোলটা দেওয়ায় মাঠে এমন চেঁচামেচি উঠল যে, মাধববাবুর গলার স্বর কারো কানে পেীছল না। তবে লোকগুলো উল্লাসের চোটে বেহেড হয়ে নাচতে শুরু করায় মাধববাবুর একটু সুবিধে হয়ে গেল। লোকে যেমন দু হাতে গাছ ফাঁক করে পাটখেতে ঢোকে তিনিও তেমনি নৃত্যরত লোকগুলোকে বন্দুকের কুঁদো আর হাত দিয়ে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লেন এবং একেবারে সামনের সারিতে চলে এলেন। মাধববাবু যে বে-আইনিভাবে ঢুকছেন সেটা সামনের সারির লোকেরা কতকটা বুঝলেও তাঁর হাতে বন্দুক দেখে কেউ কিছু বলতে সাহস পেল না।
তিন গোল খেয়ে হাফটাইমের আগেই হেতমগড় হেদিয়ে পড়েছে। প্লেয়াররা যেন সব কোমরসমান জল ভেঙে হাঁটছে এমন করুণ অবস্থা। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে অন্তত আধ ডজন গোল খাবেই। ভব তারিণী স্মৃতি শীল্ড বলতে গেলে লাতনপুরের পকেটে। মাধববাবু দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ইশ ইশ! চুকচুক। ছিঃ ছি! রাম রাম! দূর দূর! ঘেন্না ঘেন্না লজ্জা লজ্জা! করতে লাগলেন।