নন্দকিশোর চিড়বিড়িয়ে উঠে বলল, “কভি নেহি! কভি নেহি। মানুষের উপকার আর কক্ষনো নয়। তুমি নিতান্ত হাবা-গঙ্গারাম বলে আর মানুষের মতো মানুষ নও বলে তোমার খানিকটা উপকার করে ফেলেছি। এখন দেখছি তুমিও খুব সেয়ানা। আর উপকারের মধ্যে আমি নেই। বেঁচে থাকতে বিস্তর মানুষের উপকার করেছি। ফলে আমাকে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হয়েছিল। ফের উপকার করতে গিয়ে ফেঁসে যাব নাকি! তার ওপর এখন গলায় দড়ি দিয়ে মরবারও উপায় নেই।”
এই বলে নন্দকিশোর গোত্তা খেয়ে মাধবের মুখে ঢুকে পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে গেল।
বনমালী ভাবল, কর্তাকে ভূতে ধরেছে। এই সুড়ঙ্গের ঘোর অন্ধকার পাতালপুরীতে সেটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তাছাড়া গুপ্ত ধনের কাছেপিঠে এরা থাকেই। বনমালী হঠাৎ ভয় খেয়ে শিউরে উঠে “ভূত! ভূত! বলে চেঁচিয়ে দৌড়তে লাগল।
কিন্তু এই পাতালপুরীতে দৌড়ে যাবে কোথায়? দশ কদম যেতে না-যেতেই একটা দেয়ালে মাথা ঠুকে যাওয়ায় ‘উঃ’ বলে বসে পড়ল। আর বসেই চেঁচিয়ে উঠল, “কর্তা, এধারে আসুন তো।”
মশাল নিবুনিবু হয়ে এসেছে। মৌচাকে আর মোম নেই। সাবধানে মাধব এগিয়ে গেলেন। বনমালী বলল, “এই পাথরটা যেন আমার ধাক্কায় একটু নড়ে উঠল। দেখুন তো।”
কথাটা সত্যি। পাথরটা একটু ঠেলতেই নড়ল। এবং টানতেই কপাটের মতো খুলে গেল।
মাধব মশালের শেষ আলোটুকুতে মুখ ঢুকিয়ে দেখলেন, ভিতরে একটা ঘর। ঘরে অনেক জিনিস রয়েছে। মাধব ঘরে ঢুকলেন।
সামনেই একটা পিলসুজে মস্ত প্রদীপ রয়েছে। মাধবের বুদ্ধি খেলছে। বুঝলেন, প্রদীপ আছে, তখন খুজলে তেলও পাওয়া যাবে।
বেশি খুজতে হল না। পুরনো একটা গাড়তে বিস্তর রেড়ির তেল পাওয়া গেল। নিবন্ত মশাল দিয়ে প্রদীপটা একেবারে শেষ মুহূর্তে জ্বালাতে পারলেন মাধব। সেই আলোয় চারদিকে চেয়ে একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেললেন। সেই হারানো মোহরের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর দুঃখের কিছু নেই।
মাধব আস্তে আস্তে গিয়ে প্রকাণ্ড লোহার সিন্দুকটার গায়ে হাত বোলালেন। প্রদীপের আলোয় দেখলেন, সিন্দুকের গায়ে খোদাই করে লেখা : এই সম্পদ ভোগের জন্য নহে। ইহার দ্বারা প্রজাপালন, কূপ, পুষ্করিণী ইত্যাদি খনন, সড়ক প্রভৃতি নির্মাণ করিবে। বিদ্যা ও ধর্ম দান করিবে। সতত অপরের মঙ্গল চিন্তা না করিলে এই সম্পদে অধিকার জন্মায় না, ইহা জানিও। সর্বদাই চিন্তা করিবে। আমি অক্রোধী, আমি অনামী, আমি নিরলস, আমি ইষ্টপ্রাণ, সেবাপটু…
৬. নবতারণ পথেই খবর পাচ্ছেন
নবতারণ পথেই খবর পাচ্ছেন, বিজয়পুরের জমিদারমশাই মাধবের সন্ধানের জন্য পুরস্কারের টাকা বাড়িয়ে পঞ্চাশ হাজারে উঠেছেন।
সুতরাং নবতারণ দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে জঙ্গল তোলপাড় করে ফেলতে লাগলেন। কিন্তু হেতমগড়ের পাজি জঙ্গলও কিছু কম যায় না। অত সেপাই লোকলশকর সবই যেন ক্রমে-ক্রমে জঙ্গলের মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে লাগল।
নবতারণের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত ছিল ভজহরি আর পুটিম। কিন্তু একসময়ে তারাও তাল রাখতে পারল না। নবতরণ সন্ধের মুখে-মুখে দেখলেন, তিনি ভয়াবহ জঙ্গলটায় একেবারে একা। ওদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। পথের চিহ্নও নেই। ঘোড়ার মুখে ফেনা উঠেছে।
ক্লান্ত নবতারণ একটা জলার ধারে ঘোড়া থামালেন। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ঘোড়ার লাগাম ধরে খুব সাবধানে পাথরের চাইতে পা রেখে রেখে জলের ধারে গিয়ে দুজনে জল খেলেন। জল খেতে গিয়েই নবতারণ হঠাৎ দেখতে পেলেন কাদায় মানুষ আর বাঘের পায়ের ছাপ। তিনি বোক। লোক নন। বুঝলেন, আশপাশেই আসামীদের ঠিকানা মিলবে। বাঘকে তার বিশেষ ভয় নেই। সঙ্গে গুলিভরা দুটো রিভলভার আছে। আর আছে টর্চ।
নবতারণ ঘোড়ার পিঠে চেপে আস্তে-আস্তে চারদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। এবং হঠাৎই তার নজরে পড়ল, একটা জামগাছে ভাঙা মৌচাকের দগদগে দাগ। তাজা মধুর ফোঁটা পড়ে মাটি ভিজে আছে। মধুর ফোঁটার একটা লাইনও গিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছে। মধুর চিহ্ন ধরে এগিয়ে গেলেন অসম-সাহসী নবতারণ। দু-একবার ভুল পথে গেলেও অবশেষে দেখতে পেলেন, একটা পুরনো ইদারার মধ্যে একটা লতা নামানো রয়েছে।
নবতারণ নিঃশব্দে ঘোড়া থেকে নামলেন। লতাটার জোর পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হয়ে নেমে পড়লেন ইদারার মধ্যে। টর্চের আলোয় সুড়ঙ্গের মুখটা পেতেও তাঁর দেরি হল না।
সুড়ঙ্গে ঢুকে টর্চ ফেলে ব্যাপারটা বুঝে নিতে তার মোটেই সময় লাগল না। লখনউয়ের ভুলভুলাইয়ায় তিনি বহুবার ঢুকেছেন। এ সুড়ঙ্গ সে-তুলনায় ছেলেমানুষ।
মাত্র মিনিট পনেরোর মধ্যেই তিনি গুপ্ত কুঠুরির দরজায় পৌঁছে ভিতরে টর্চের আলো ফেললেন এবং রিভলভার তুলে ধরে বললেন, “মাধববাবু! বনমালী! হাস আপ।”
দুই ফেরারি আসামী হাত তুলে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল দেখে নবতারণ একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, “কোনো চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। আমার ফোর্স জায়গাটা ঘিরে ওপরে অপেক্ষা করছে। খুব সাবধানে হাত তুলে বেরিয়ে আসুন।”
ঠিক এই সময়ে মাধবের নাক দিয়ে নন্দকিশোর উঁকি মারে, “ছ্যাঃ ছ্যাঃ! এ যে একেবারে কেচ্ছা করলে হে মাধবচন্দ্র। তীরে এসে ভরাডুবি! তা ঐ ভিতুর ডিম দারোগাটাকে ভয় খাওয়ারই বা কী আছে? তুমি তো বাপু গায়েগতরে কিছু কম নও, লাফিয়ে পড়ে জাপটে ধরে পেড়ে ফেল না।”