“আছি! আছি!” চেঁচিয়ে উঠলেন মাধব। তারপর ঘটোৎকচকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “দাদু! দাদু গো! এ-জন্মেও আমাকে ভোলোনি তাহলে?”
জঙ্গল ফুড়ে খিদেয় চিমড়ে-মারা চারটে মূর্তি বেরিয়ে এসে ধপাস ধপাস করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। মাধবের ভারী মায়া হল। বললেন, “বোসো তোমরা, ব্যবস্থা আছে।
ভায়গাটা এখন চেনা হয়ে গেছে। মাধব গিয়ে জামগাছের ডাল থেকে মৌচাকটা পুরো ভেঙে আনলেন। মধুতে এখনো ভরা-ভর্তি। টপটপ করে মধুর ফোঁটা পড়ে চাকের নীচে মাটি ভিজে গেছে, পিঁপড়ে লেগেছে।
চাক নিয়ে এসে চারজনকে আকণ্ঠ মধু খাওয়ালেন মাধব। সকলের পেট ঠাণ্ডা হল, গায়ে জোর বল এল।
মুখে কথা ফোঁটার মতো অবস্থা হতেই বনমালী বলে উঠল, “কা! এ জায়গাটা যে বড় চেনা-চেনা ঠেকছে।”
মাধব তখন গোটা ব্যাপারটাই ভেঙে বললেন। সবাই শুনে তাজ্জব হয়ে গেল। বনমালী তার টিকটিকি-বিদ্যে-জানা স্যাঙাতকে হুকুম দিল, “ইদারায় নাম।”
লোকটা কালবিলম্ব না করে তরতর করে ইদারার ভিতরের খাঁজে পা আর হাতের ভর রেখে শা করে নেমে গেল। ওপর থেকে সবাই বুকে দেখছে, লোকটা জলের কাছ-বরাবর নেমে চারদিকে গুপ্ত দরজা বা গর্ত খুঁজছে। অনেকক্ষণ খুঁজল। তারপর কিছু না পেয়ে ওপর দিকে চেয়ে বনমালীর উদ্দেশে বলল, “ওস্তাদ, এখানে তো কিছু দেখছি না।”
ঘটোৎকচ কী বুঝল কে জানে। হঠাৎ সে হুপ করে হাঁক ছেড়ে ইদারার মধ্যে সাবধানে নামতে লাগল। আধাআধি নেমে একটা পাথরের চাই ধরে টানাটানি করতে করতে চেঁচাতে লাগল, হুপ! হুপ!
তখন টিকটিকি-ওস্তাদ নীচে থেকে ঘটোৎকচের কাছ-বরাবর উঠে এসে পাথরটা ভাল করে দেখে-টেখে বলল, “এ পাথরটা একটু অন্যরকম।”
বেলা ফুরিয়ে আসছে। জঙ্গলের প্রচণ্ড হাড়কাঁপানো শীতও মালুম দিচ্ছে। বনমালী আর দেরি না করে তার আর-দুই স্যাঙাতকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে লম্বা-লম্বা কয়েকটা লতানে গাছ ছিঁড়ে আনল। কাছেই একটা মস্ত গাছের গুঁড়িতে লতার এক মাথা বেঁধে অন্য মাথা ঝুলিয়ে দিল ইদারার মধ্যে। তারপর একে একে বনমালী আর তার এক স্যাঙাত নেমে গেল নীচে।
তিনজন মিলে পাথরটার ওপর কী ক্রিয়া-কৌশল করল, ওপর থেকে মাধব তা ভাল বুঝলেন না। তবে কিছুক্ষণ বাদে দেখতে পেলেন পাথরটা দরজার কপাটের মতো খুলে গেছে। বনমালী চেঁচিয়ে বলল, “কর্তা, ঝুল খেয়ে নেমে আসুন। এখানে একটা সুড়ঙ্গ পাওয়া গেছে।”
উৎসাহের চোটে মাধবের আর ভয়ডর রইল না। লতা বেয়ে নেমে গিয়ে দেখলেন, বাস্তবিকই একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গ হাঁ করে আছে। স্যাঙাতদের একজনের কাছে দেশলাই ছিল। তাই দিয়ে মৌচাকটাতে আগুন দেওয়ায় দিব্যি আলো জ্বলে উঠল। একটা গাছের ডালের আগায় জ্বলন্ত মৌচাকটাকে গেঁথে নিয়ে মাধব সদলে সুড়ঙ্গে ঢুকলেন। এত নিচু আর সরু সুড়ঙ্গ যে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়। ভিতরে বদ্ধ ভ্যাপসা ভাব। চারদিকে নিরেট পাথরের দেয়াল। মশালের আগুন আর ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়।
খানিকদূর গিয়ে সুড়ঙ্গটা কিছু চওড়া হল। ছাদটাও একটু উঁচুতে। সামনে গলিটা দুভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে। সেইখানে সবাই দু’দণ্ড জিরিরে হাঁফ ছাড়ে। বনমালী বলল, “কর্তা, আমরা ছ্যাচড়া হলেও নিমকহারাম নই, চোর হলেও লোভী নই। যদি গুপ্তধন পাওয়া যায় তবে সবটাই আপনার। আপনি আবার হেতম গড় গা তৈরি করুন! আমাদের শুধু সেখানে থাকতে দেবেন। কথা দিচ্ছি, হেতমগড়ে কখনো চুরি-ডাকাতি হবে না!”
মাধব রাজি হলেন। সেখানেই ঠিক হল, মাধব বনমালী আর ঘটোৎকচকে নিয়ে যাবেন ডাইনে, তিন স্যাঙাত যাবে বাঁয়ে। ঘণ্টা দুই পর তারা আবার এখানে ফিরে আসবে। মৌচাক ভেঙে দুটো মশাল তৈরি করে তারা দুদিকে এগোলেন।
মাধব ডানদিকের রাস্তা ধরে এগোচ্ছেন। সামনে ঘটোৎকচ পিছনে বনমালী। চারদিকে পাথরের দেয়াল চলেছে তো চলেইছে। মাথা নিচু না করে যাওয়ার উপায় নেই। মাধবের ঘাড় টনটন করে ছিঁড়ে পড়ার জোগাড়। তার ওপর এই শীতকালেও সুড়ঙ্গের ভিতরটায় বেজায় ভ্যাপসা গরম। অনেকক্ষণ চলার পর মাধব হঠাৎ বুঝলেন, সুড়ঙ্গটা হচ্ছে আসলে একটা ভুলভুলাইয়া বা গোলকধাঁধা। কোনোখানেই পৌঁছচ্ছেন না, কেবলই যেন একই জায়গায় ঘুরে মরছেন।
খুবই ক্লান্ত হয়ে একসময়ে পাথরে ঠেস দিয়ে বসে পড়লেন মাধব। পাশে বনমালী আর ঘটোৎকচ।
মুখে কথা পর্যন্ত সরছে না কারো। ঠিক এই সময়ে মাধব শুনতে পেলেন, নন্দকিশোর কানে-কানে বলছে, “খুব কানামাছি খেললে বাপু! তা আমাকে যে ফেলে এলে, আমি কি তোমার গুপ্তধনে ভাগ বসাতুম?”
মাধব গম্ভীর মুখে বললেন, “আপনার মতো অপদার্থ ভূত জীবনে দেখিনি।”
“বেশি কচকচ কোরো না ছোঁকরা। তোমার ঐ বাঁদরটার গায়ের গন্ধ আমার যদি অসহ্য না হত তাহলে আজ তোমাকে ভুল পথে নিয়ে গিয়ে বিস্তর নাকাল করতুম। যাক গে, এখন হাঁ করো তো, ভিতরে সেঁদিয়ে যাই।”
বনমালী হাঁ করে মাধবের মুখের দিকে চেয়ে ছিল। বলল, “ও কার সঙ্গে কথা বলছেন আপনি? এখানে তো আমি ছাড়া আর কোনো মনিষি নেই।”
মাধব সেকথার জবাব না দিয়ে নন্দকিশোরকে বললেন, “অপকার সবাই করতে পারে। উপকারটাই করতে পারে না। এই যে গোলকধাঁধায় পড়ে খাবি খাচ্ছি, তার একটা উদ্ধারের পথ আগে বের করে দিন, তারপর বড়-বড় কথা বলবেন। প্রথম থেকেই তো ফাড়া কাটছেন, ভূত এটা পারে না, সেটা পারে না। ও কেমনধারা কথা!”