বসে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ তার মনে হল, সামনের পাথরের চাঁইগুলো কেমন যেন চৌকো ধরনের। মনে হয় বহু পুরনো কোন বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ির ধ্বংসাবশেষ। তারপরেই মাধবের নজর পড়ল গাছের গুঁড়িটার দিকে। ওপরে শ্যাওলা জমে আছে। মাধবের সন্দেহ হওয়াতে নখ দিয়ে খুটলেন এবং দেখলেন, এটা মোটেই গাছের গুঁড়ি নয়। একটা প্রাচীন থাম। মাধব একটু চমকে উঠলেন। এসবের মানে কী? চারদিকে চেয়ে এ-জায়গাটা ভঁর চেনা-চেনা ঠেকছে। দৈবক্রমে হেতমগড়ের হারানো বাড়িতে ফিরে আসেননি তো?
এই কথা মাত্র ভেবেছেন, হঠাৎ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বাজ পড়ার মতো ‘ঘ্রাম’ করে গর্জন ছাড়ল বাঘটা। ঘুম থেকে উঠে কপিশ চোখে সোজা তাকিয়ে আছে মাধবের দিকে।
বুকটা কেঁপে ওঠায় মাধব প্রথমটায় ককিয়ে উঠেছিলেন। হয়তো অজ্ঞানও হয়ে যেতেন। কিন্তু হঠাৎ নাকের ফুটো দিয়ে নন্দকিশোর মুখ বার করে বলল, “বড় চেঁচামেচি হচ্ছে হে। একটু ঘুমোতেও দেবে না নাকি?”
“আমি চেঁচাইনি। চেঁচাল তো ঐ বাঘটা।” মাধব বললেন।
নন্দকিশোর বাঘটার দিকে বিরক্তির দৃষ্টি হেনে বলল, “লক্ষণ ভাল ঠেকছে না। পালাও।”
“কোথায় পালাব?”
“সে আমি কী জানি! আমাকে তো আর বাঘে খাবে না। খেলে তোমাকেই খাবে। ঐ যে আসছে!” বলে নন্দকিশোর আবার নাকের ফুটো বেয়ে সুট করে মাধবের ভিতরে ঢুকে যায়।
বাঘটা সত্যিই পায়ে-পায়ে এগিয়ে আসছে। খুবই নিশ্চিন্ত ভাব ভঙ্গি। একবার প্রকাণ্ড একটা হাইও তুলল। মাধব ভয়ে সিটিয়ে আছেন। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে, সারা রাত বাগে পেয়েও যখন বাঘে তাকে খায়নি, তখন এই সাত-সকালেও বোধহয় খাবে না। তাছাড়া চিতাবাঘ সাধারণত মানুষ খায়ও না, কিন্তু বেগরবাই দেখলে মারে। এই বাঘটার ব্রেকফাস্ট হয়েছে কিনা তা বুঝতে না-পারায় মাধব খুব নিশ্চিন্তও বোধ করতে পারছেন না।
বাঘটা এসে মাধবের সামনে থাবা গেড়ে বসল এবং খুব মন দিয়ে মাধবের মুখোনা দেখতে লাগল। তাতে খানিকটা ভয় কেটে গিয়ে মাধবের একটু লজ্জা-লজ্জা করছিল। কারণ, আজ দাড়ি কামানো হয়নি। কাল থেকে নানা ঘটনায় নাকাল হয়ে চেহারাটা হয়েছে ঝোড়ো কাকের মতো। তার ওপর দাঁত নেই। চুলটা ঠিক মতো পাট করা নেই। মাধব বাঘের দৃষ্টির সামনে লজ্জায় অপোবদন হয়ে বসে রইলেন।
বাঘটা এবার মোলায়েম গলায় বলল, ভ্রাম!
মোলায়েম হলেও এই আওয়াজেও পিলে চমকে যায়। মাধবেরও চমকাল।
বাঘটা একটু ঘুরে বসে আচমকাই লেজটা মাধবের কোলের ওপর বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ঘর-র।
মাধব আঁতকে উঠলেন। অমনি নন্দকিশোর কানে কানে বলল, “তোমাকে লেজটা ধরতে বলছে।”
“ধরব?” মাধব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“না-ধরেই বা কী করবে?”
“তাই তো!” বলে মাধব খুব সংকোচের সঙ্গে লেজটা ধরলেন। বাঘটা তখন ধীরে ধীরে তাকে টেনে নিয়ে চলল।
পুবধার দিয়ে জলাটা ঘুরে বাঘটা তাকে একটা ভারী সুন্দর সাজানো জঙ্গলে নিয়ে এল। মনে হয়, এখানে এককালে মস্ত কোনো বাগান ছিল। হাঁ করে চারদিকে চেয়ে দেখছেন মাধব। বাগানের চারধারে কোনো পাঁচিলের চিহ্নও নেই। তবে একটা জায়গায় একটা মস্ত গোল বাঁধানো চৌবাচ্চার আকৃতি মাটির মধ্যে দেখতে পেলেন। খুবই চেনা-চেনা ঠেকছে।
বাঘটা একটা হ্যাঁচকা টানে লেজ ছাড়িয়ে নিয়েছে। তারপর একটা বেঁটে জামগাছের দিকে এগোচ্ছে দুলকি চালে। মাধব বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে দেখছেন।
জামগাছের নিচু ডালে মস্ত বড় একটা মৌচাক। বিজবিজ করছে মৌমাছি। বাঘটা গিয়ে এক লাফে গাছের ডালে উঠে ধীরে ধীরে চাকটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাধব দম বন্ধ করে আছেন। আচমকা নাড়া পড়লে মৌমাছিরা যে কী কাণ্ড ঘটাবে।
কিন্তু বাঘটার বুদ্ধির প্রশংসাই করতে হয়। হুট করে কোনো কাণ্ড ঘটাল না। বরং খুব ধীরে ধীরে সামনের পা দুটো দিয়ে ডালটাকে নাড়াতে লাগল। যেন বাতাসের দোলা। একটি দুটি করে মৌমাছি চাক থেকে উড়ে যেতে লাগল। বাঘটা আস্তে-আস্তে দুলুনি বাড়াতে থাকে। মাঝে মাঝে আচমকা একটু ঝাঁকুনি দেয়। মৌমাছিরা পালাচ্ছে। উড়ছে, ফিরে আসছে, আবার উড়ে যাচ্ছে। প্রায় আধঘণ্টার চেষ্টায় চাকটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল। মাধব দূর থেকেও দেখতে পেলেন, টসটস করছে মধু।
বাঘটা বলল, ভ্রাও।
নন্দকিশোর সঙ্গে-সঙ্গে কানে-কানে কথাটা অনুবাদ করে বলল, “তোমাকে খেতে বলছে। শুনলে না, খাও!”
“খাব?”
“না খেয়েই বা করবে কী? বাঘকে চটানে কি ভাল? বাঘটাকে খুব ভাল বাগিয়েছ হে!”
বাঘটা চাকটাকে মৌমাছিশূন্য করে আর দাঁড়াল না। জঙ্গলের মধ্যে বোধহয় হরিণের গন্ধ পেয়েই এক লাফে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাধব নিশ্চিন্তে এগিয়ে গিয়ে চাকটার নীচে দাঁড়ালেন। হাতের নাগালের মধ্যে একেবারে নাকের ডগায় জিনিসটা ঝুলে আছে। মাধব আর দেরি না করে চাকটার খানিকটা ভেঙে নিয়ে মুঠোয় চাপ দিয়ে সেরটাক রস বের করে খেয়ে ফেললেন। বহুকাল এরকম ভাল পদ্মমধু খাননি। প্রাণ বুক ঠাণ্ডা হয়ে গেল। চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। তারপর চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন।
যত দেখেন ততই ধারণা হতে থাকে, এ সেই হেতমগড়ের রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ না হয়ে যায় না। এক জায়গায় তিনি বেশ কয়েকটা বড় বড় শ্বেতপাথরের টুকরো দেখতে পেলেন। ঝোঁপ জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙা পেতলের কলসির গায়ে দেখলেন নাম খোদাই করা–আর. সি.। সম্ভবত তার বাবার নামের আদ্যক্ষর। বাবার একটাই ছিল শখ। সব কিছুতে নিজের নামের আদ্যক্ষর খোদাই করতেন। সুতরাং মাধবের আর সন্দেহ রইল না, দৈবক্রমে নিজেদের হারানো ভিটের সন্ধান তিনি পেয়েছেন।