কিন্তু মাধববাবুর কথাটা কেউ তেমন বিশ্বাস করল না। এ-বাড়ির বুড়ো দারোয়ান তায়েবজি সাফ-সাফ বলে দিল, “মাধুবাবু কোনোদিন রাতে ওঠেন না। রাতভর তার নাকের ডাকে পাড়ার লোকের অসুবিধে হয়, চোর ডাকু সব তফাত থাকে।”
মাধববাবু এইসব কথায় অল্পস্বল্প রেগে যাচ্ছিলেন। তবে তখনো একদম রেগে টং হয়ে যাননি। তায়েবজির কথার জবাবে বললেন, “আমার ছেলেবেলা থেকেই ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানোর অভ্যাস আছে। এখন আবছা মনে পড়ছে কাল রাতেও আমি খানিকক্ষণ জীপ-ওয়াকিং করেছিলাম যেন। দরজা খুলে বারান্দায় এসেও হাঁটাহাঁটি করেছি।”
এসব কথা বলতে বলতে মাধববাবু টের পাচ্ছিলেন যে, তিনি খুবই রেগে যাচ্ছেন। আর কথা চালাচালি হলে এবার তাঁর ভিতরে রাগের বোমাটা ফাটবে। তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন, তার মাথার ভিতরে ঠিক ব্ৰহ্মতালুতে বোমাটা বসানো রয়েছে। বোমার পলতেয় আগুন দেওয়া হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে পুড়তে পুড়তে পলতেটা ছোট হয়ে এসে বোমার গায়ে প্রায় লাগে-লাগে।
ঠিক এই সময়ে অক্ষয় খাজাঞ্চি এসে বলল, “হিম শেখ পাতুগড়ের আমবাগানটা কিনবে বলে বায়না দিতে এসেছে।”
ব্যস, বোমাটা ফাটল দড়াম করে। সবাইকে চমকে দিয়ে ধমকে ওঠেন মাধববাবু, “ইয়াকি পেয়েছ? মস্করা পেয়েছ সবাই? জানো, মাধব চৌধুরী ভাল থাকলে গঙ্গাজল, আর রাগলে মুচির কুকুর?”
রোগাভোগা অক্ষয় খাজাঞ্চি ভয় পেয়ে তিন হাত পিছিয়ে চৌকাঠের ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল। তায়েবজি তার মোটা গোঁফ চোমরাচ্ছিল, আঁতকে ওঠায় একদিকের গোঁফ আঙুলের টানে ঝুলে পড়ে চিনেম্যানের গোঁফ হয়ে গেল। হাঁড়ির মা ঘর মোছর ন্যাতা দিয়ে ভুল করে নিজের মুখ মুছে ফেলল। বড়বাবুর ইজিচেয়ারটা হঠাৎ একটা দোল খেয়ে গেল জোরে। পল্টনের মুখ এমনভাবে হাঁ হয়ে ছিল যে, একটা বোল ভুল করে ঢুকে পড়ল তার ভিতরে আর পল্টনও ভুলে কেঁত করে গিলে ফেলল সেটাকে। বাড়ির আরো লোকজন সব দৌড়ে এসে ভিড় করল চারধারে।
মাধববাবু চেঁচাতে লাগলেন, “জানো, আমার দু দুটো দোনলা বন্দুক আছে! সরস্বতীর চরে গায়েব হওয়া বসতবাটী খুঁজে পেলে এখনো আমি চার-পাঁচলাখ মোহরের মালিক, তা মনে আছে তো? হিসেব করে কথা কও না, এত আম্পদ্দা তোমাদের?”
অক্ষয় খাজাঞ্চি বাইরে থেকে মৃদু স্বরে বলে, “আজ্ঞে কথাটা হচ্ছিল পাতুগড়ের আমবাগানটা নিয়ে। বৃকোদরের কথা বলিনি আজ্ঞে।”
অক্ষয় খাজাঞ্চি বহুদিন ধরেই ঘটোৎকচকে ভুল করে বৃকোদর বলে আসছেন। বহুবার তার ভুল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবু মনে রাখতে পারেন না।
মাধববাবু হুংকার দিয়ে উঠলেন, “চালাকির আর জায়গা পেলে! তোমাদের সব চালাকি আমি জানি। এই মুহূর্তেই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চললাম। যেখানে মানুষ আত্মসম্মান নিয়ে থাকতে পারে না সেখানে থাকার চেয়ে জঙ্গলে থাকা ভাল। আর শোনো অক্ষয়, তোমাকে এই শেষবারের মতো বলে যাচ্ছি, দ্বিতীয় পাণ্ডব বৃকোদরের সঙ্গে কখনো ঘটোৎকচকে গুলিয়ে ফেলো না। তাতে বৃকোদরের অপমান। ঘটোৎকচ তার ছেলে ছিল বটে, কিন্তু তার মা ছিল রাক্ষসী। তাই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ঘটোৎকচকে স্যাক্রিফাইস করতে কারো বাধেনি। তোমাদের ঐ নোংরা, পাজি, চোর, হাড় হাভাতে ঘটোৎকচকেও তোমরা স্যাক্রিফাইস করে দাও। তাতে সকলেরই মঙ্গল। নইলে আর একটা কুরুক্ষেত্র লাগল বলে।”
এই শেষ কথা উচ্চারণ করে মাধববাবু তার দুটো পুরনো দোনলা বন্দুকের বাক্স, শতরঞ্চিতে বাঁধা বিছানা আর একটি টিনের তোরঙ্গ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। এমনকী, নিজের দিদির সঙ্গে পর্যন্ত দেখা করলেন না।
দেউড়িতে বড়বাবু, পল্টন, অক্ষয় খাজাঞ্চি, তায়েবজি সমেত বাড়ির বহু লোক তার গৃহত্যাগ রোধ করতে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কারো কথায় কর্ণপাত করার লোক তিনি নন। এর আগে আর না হোক পঞ্চাশবার তিনি গৃহত্যাগ করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁকে খুবই দক্ষ বলতে হবে। তাই তাকে ফেরানো যাবে না জেনে বড়বাবু একটা মোষের গাড়ির বন্দোবস্ত পর্যন্ত রেখেছেন।
বাইরে বেরিয়ে মাধববাবু তাঁর মালপত্র নিয়ে সোজা গিয়ে গাড়িতে চেপে বসলেন।
সরস্বতী নদীর ধারে লাতনপুরে মাধববাবুর এক খুনখুনে বুড়ি
পিসি থাকেন। তিনি চেনা লোককেও চিনতে পারেন না, চোখে দেখতে পান না, কানেও শোনেন না। সারাদিন আপনমনে বকবক করতে করতে ঘরের হাজারো কাজ করে বেড়ান। তার ছেলেপুলে আর নাতি-নাতনি নিয়ে বিশাল সংসার। মাধববাবু রাগ করে ঘর ছাড়লে এর বাড়িতেই এসে ওঠেন। আজও উঠলেন।
মাধববাবু যেখানেই যান, সেখানেই একটা হৈ-চৈ পড়ে যায়। তিনি দারুণ গল্প বলতে পারেন, এটেল মাটি দিয়ে চমৎকার পুতুল গড়তে পারেন, গানবাজনা করতে পারেন। তাই তাঁকে দেখেই বাড়ির কাচ্চাবাচ্চাদের কিছু দৌড়ে এসে গাড়ির গায়ে ঝুলতে শুরু করল, কেউ কোলেপিঠে চড়ে বসল, আবার একটু বড় যারা তারা দৌড়ে গেল মাধববাবুর পিসিকে খবর দিতে।
বাইরের ঘরে মাধববাবু জমিয়ে বসেছেন। বাচ্চারা তাঁর বন্দুকের বাক্স, তেরঙ্গ আর বিছানা টানা-হঁচড়া করে খোলবার চেষ্টা করছে। বাড়ির এক বউ এসে বাতাস দিচ্ছে, এক বউ জলের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে, পিসতুতো ভাইয়েরা এসে খোঁজখবর নিচ্ছে। এমন সময় কোলকুঁজো হয়ে ঘরে ঢুকে পিসি তাঁকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, “অচেনা লোক ঘরে ঢুকতে দিয়েছিস! চোর-ছ্যাচড় নয় তো! দেখিস আবার বাসন-কোসন কাপড়-চোপড় পোঁটলা বেঁধে না শটকান দেয়। এর মুখচোখ দেখে তো ভাল লোক মনে হচ্ছে না।”