ঘন জঙ্গলের মধ্যে কোথাও-কোথাও হঠাৎ গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত রোদের দেখা পাওয়া যায়। কোথাও ঝিঝি ডাকে, দু-একবার হরিণের বিচ্ছিরি কাসির শব্দও পেলেন। কাসি নয়, ওটাই হরিণের ডাক। আশেপাশে বনমোরগেরাও থেকে থেকে ডাক দিয়ে জানান দিচ্ছে যে, এ জঙ্গলটা মানুষের জন্য নয়। পায়ের তলায় মাঝে-মাঝে কাদা জমি টের পাচ্ছেন মাধব, কখনো ভেজা গাছের পাতা জমে গালিচার মতো নরম বস্তুর ওপর আরামে পা ফেলছেন। এক জায়গায় একটা ঝর্নার জল বয়ে যাচ্ছে দেখে দু কোষ ঠাণ্ডা জল খেয়ে নিলেন। কত করে একটা শ্বাস ফেলে ভাবলেন, এই জঙ্গলেরই কোথাও আমাদের বসতবাড়িটা ছিল।
আবার অন্ধকার জঙ্গলে ঢুকে চলেছেন তো চলেছেনই। পথ আর ফুরোয় না। ঘটোৎকচেরও কি ক্লান্তি নেই? মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে লেজটা ছেড়ে দুহাতে জামা তুলে মুখ মুছে নিচ্ছেন। আবার শেষ অবলম্বনের মতে, শিবরাত্রির সলতের মতো লেজটা চেপে ধরছেন।
একসময়ে মাধবের মনে হল, লেজটা যেন কিছু মোটা মনে হচ্ছে! মনের ভুলই হবে। তবু লেজটা একটু হাতিয়ে দেখে নিলেন। সন্দেহটা থেকেই যাচ্ছে। লেজটা কিছু মোটাই।
আস্তে করে ডাকলেন, “ঘটোৎ! এই ঘটোৎ।”
ঘটোৎকচ সাধারণত হুপ বলে জবাব করে। কিন্তু মাধব কোনো হুপ শুনতে পেলেন না।
ভয়ে-ভয়ে আবার ডাকলেন, “ঘটোৎ রে! বাবা ঘটোৎকচ!”
জবাব দিল না কেউ। কিন্তু দিব্যি সরসর করে টেনে নিয়ে চলল ঠিকই। নিকষ কালো একটা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলেছেন মাধব। বাইরে বোধহয় সন্ধেও হয়ে এল। তাই সামনে কিছুই নজরে পড়ছে না। মাধব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কী খেয়ে হঠাৎ এত মোটা হয়ে গেলি বাপ ঘটোৎকচ!”
কেউ জবাব দিল না। তবে গতি অব্যাহত রইল।
হাঁটতে-হাঁটতে হয়রান হয়ে গেলেন মাধব। হঠাৎ টের পেলেন জঙ্গলটা যেন একটু পাতলা হয়ে আসছে। আকাশের দিকে তাকালে গাছপালার ফাঁক দিয়ে দু-একটা তারার চিকিমিকি, একটু জ্যোৎস্নার মলম দেখা যায় যেন!
বড়-বড় গাছের সারি শেষ হয়ে হঠাৎই বেঁটে-বেঁটে ঝোঁপঝাড়ে পড়লেন মাধব। বেশ জোরেই যাচ্ছেন। তারপরই দেখেন, জ্যোৎস্নায় সামনে একটা জলা দেখা যাচ্ছে। জলার ধারে ধারে
মাঝে-মাঝে দপদপ করে মশালের মতো আলেয়ার আলো জ্বলে উঠছে। ঘটোৎকচও বেশ আন্তে চলছে এখন। একবার থেমেও পড়ল। হাঁফ ছেড়ে মাধব এতক্ষণে লেজটার দিকে তাকানোর ফুরসত পেলেন।
যা দেখলেন তাতে বেশ অবাকই হওয়ার কথা। ঘটোৎকচের সেজে কে বা কারা কালো আর হলুদ রঙ দিয়ে চিত্তির-বিচিত্তির করে দিয়েছে। ফলে লেজটা আর আগের মতো বিচ্ছিরি দেখতে নেই। বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছে।
“বাঃ! বাঃ!” বলে মাধব লেজটায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তোর সারা গা’টা এরকম চিত্তির-বিচিত্তির হলে দেখতে বেশ সুন্দর হয়ে উঠবি রে ঘটোৎ!”
বলতে-বলতে তিনি ঠাহর করে দেখেন, শুধু লেজ নয়, ঘটোৎকচের শরীরেও কালো আর হলুদ ছোপছক্কর দেখা যাচ্ছে। তবে বেঁটে গাছের জঙ্গলে শরীরের বারো আনাই ডুবে আছে বলে শুধু পিঠটাই দেখতে পেলেন মাধব।
মাধব খুশি হয়ে বললেন, “বাঃ! বাঃ! তোকে যে আর চেনাই যায় না রে ঘটোৎ!”
বলতে না বলতেই বেঁটে ঝোঁপের আড়াল থেকে জলার ধারের ফাঁকা জমিতে পা দিলেন মাধব। জ্যোৎস্নায় ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে বিশাল জলাটাকে। চারধারে নিবিড় জঙ্গল। অল্প কুয়াশায় ভারী স্বপ্ন-স্বপ্ন দেখাচ্ছে। প্রচণ্ড শীত যেন পাথর হয়ে জমে আছে এখানে।
এই শীতের হাঁটাহাঁটির পরিশ্রমে মাধবের কপালে ঘাম জমেছে। ঘটোৎকচের লেজে একটা টান মেরে মাধব বললেন, “একটু থাম বাবা ঘটোৎ। জিরিয়ে নিই।”
লেজে টান পড়ায় ঘটোৎ ঘর-র-র শব্দ করল। মাধব অবাক হলেন। চেহারার সঙ্গে-সঙ্গে কি ঘটোৎকচের স্বভাবটাও পাল্টে গেল। ঘটোৎ এরকম গম্ভীর আওয়াজ কখনো করে না তো!
ঘটোৎকচ একটু রেগেই গেছে। ঘর-র-র শব্দের পর ধীরে-ধীরে মুখটা ফিরিয়ে মাধবের দিকে তাকাল সে।
মাধব হিম হয়ে গেলেন। স্ট্যাচু হয়ে গেলেন। একটা আঙুলও নাড়বার ক্ষমতা রইল না আর।
ঘটোৎকচ ভেবে যার লেজ কষে ধরে আছেন, সেটা এক মস্ত চিতাবাঘ।
লেজটা ছেড়ে দিয়ে যে দৌড় দেবেন তারও উপায় নেই। আঙুল গুলো লেজটাকে যেমন ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে ঠিক সেইভাবেই আড়ষ্ট হয়ে গেল। চেষ্টা করেও আঙুলের সেই বজ্র আঁটুনি খোলর উপায় নেই।
বাঘটা জুলজুল করে চেয়ে আছে। মাধবও চেয়ে আছেন। কেউ কারো চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছে না। বাঘের গায়ের বোঁটকা গন্ধটা এখন বেশ নাকে আসছে মাধবের। কোনো ভুল নেই, সামনের জন্তুটা বাঘই বটে। জঙ্গলের অন্ধকারে কোন সময়ে যে লেজ-বদল হয়েছে তা টেরও পাননি মাধব।
কয়েক মিনিট সম্মোহিতের মতো থাকার পর মাধব গলার স্বর ফিরে পেয়ে কাঁদো-কঁদো হয়ে অনেকদিনের পুরনো একটা ছড়ার লাইন বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “দোহাই দক্ষিণরায়, এই করে। বাপা। অন্তিমে না পাই যেন চরণের থাপা।”
ঠিক এই সময়ে মাধবের ডানদিকের কানটা ভারী সুড়সুড় করে উঠল। নন্দকিশোরের মুণ্ডুটা তার ডান কানের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে
চারদিক দেখে নিয়ে বলে উঠল, “যাক বাবা! বাঁদরটা ধারে-কাছে নেই দেখছি। বাঁচালে!”
মাধব কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, “বাঁদর না থাক, বাঘ তো আছে!”
নন্দকিশোর এক গাল হেসে বলল, “বাঘকে ভূতের কোনো পরোয়া নেই। বাঘের ব্যাপার তুমি বুঝবে।”