হেরম্ব রায় ভেবেছিলেন, ওরকম জামাইয়ের মুখদর্শন আর করবেন। হেতমগড়ের সেই নামডাকও আর নেই। সরস্বতীর বানে বিষয় সম্পত্তি সবই জলে গেছে। জামাইটা তার জমিদার ভগ্নীপতির গলগ্রহ হয়ে আছে। এমন জামাইকে জামাই বলে স্বীকার করতেও লজ্জা হয়।
কিন্তু বাদ সেধেছে ফুলি। এতকাল সে চুপচাপ ছিল বটে, কিন্তু হঠাৎ এক রাতে সে স্বপ্ন দেখেছে, জামাই হতচ্ছাড়া নাকি একটা গ্যাস-বেলুন ধরে ঝুলে-ঝুলে আকাশ দিয়ে যাচ্ছে। এ-বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় নাকি সে বলে গেছে, “তিব্বতে সন্ন্যাসী হতে চললুম। আর ফিরব না।” সেই থেকে মেয়ে বেঁকে বসেছে, বাপের বাড়িতে আর থাকবে না। পাগল হোক, বোকা হোক, গলগ্রহ হোক, মাধবকে ফিরিয়ে আনতে হবে। দরকার হলে সে গাছতলাতেও থাকতে রাজি।
শুনে প্রথমটায় হেরম্ব ভীষণ চটে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফুলি হেরম্ব রায়েরই মেয়ে তো। তেজ তারও কিছু কম নয়। সে সোজা গোটা দশেক করবী ফুলের বিচি আর একটা নতুন দড়ি নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে দোর দিয়েছে। দুদিন ধরে দরজা ঠায় বন্ধ। বাইরে থেকে মা পিসি মাসি কাকা ভাই বোনের কাকুতি-মিনতিতেও দরজা এতটুকু ফাঁক হয়নি। ফুলি বলে দিয়েছে, তিনদিনের মধ্যে ছোট জামাইকে সসম্মানে হাজির করা না হলে সে হয় বিষ খাবে, নয়তো গলায় দড়ি দেবে, কিংবা দুটোই একসঙ্গে করবে। সেই থেকে হেরম্ব আর বেশি কিছু বলার সাহস পাননি।
জামাইয়ের খোঁজে গতকাল তার ভগ্নীপতির বাড়িতে লাঠিয়াল আর বরকন্দাজ পাঠিয়েছিলেন। তারা ফিরে এসে খবর দিল, জামাই নাকি রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। অগত্যা মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে তিনি চতুর্দিকে লোক-লশকর পাঠালেন। অবশেষে লাতনপুর থেকে লোকে এসে খবর দিল, ফুটবল খেলার মাঠে বন্দুক নিয়ে হামলা করার জন্য ছোট জামাইকে পুলিসে গ্রেফতার করেছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! মাধরের অন্য যে-কোনো দোষ থাক সে যে এত বড় গুণ্ডা তা হেরম্বর জানা ছিল না। তবু খবরটা শুনে হেরম্ব তেমন দুঃখ পাননি। হাজতের ভাত খেয়ে আহাম্মকটার বুদ্ধিটা একটু খুলতে পারে। তাছাড়া থানায় আটক থাকলে আর যখন-তখন এদিক সেদিক পালাতেও পারবে না।
কিন্তু কাল রাতে নায়েব এসে খবর দিল, জামাই আরো কয়েক জন আসামীকে নিয়ে হাজত ভেঙে পালিয়েছে। এ-রকম বিপজ্জনক জামাই হেরম্বর আর একটিও নেই। কালে-কালে কত কী-ই যে হচ্ছে!
কিন্তু হাল ছাড়লে তো চলবে না। তাই তিনি জামাইকে ধরার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। কাল রাত বারোটার মধ্যে জামাইকে হাজির না করতে পারলে মেয়ে ফুলি আত্মঘাতী হবে কাজেই সময়ও আর হাতে নেই।
দশ হাজার টাকার লোভে পুলিস, গেরস্ত, চাষ, সবাই মাধবের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। সুতরাং জামাই ধরা পড়বেই।
হেরম্ব জামাইয়ের খবরের জন্য উদগ্রীব হয়ে দোতলার মস্ত বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। এই সময়ে তাঁর এক চর এসে খবর দিল, “রায়মশাই, আপনার জামাই হেতমগড়ের গভীর জঙ্গলে ঢুকেছেন। উদ্ধারের আশা খুবই কম। কারণ সেখানে চিতাবাঘ ভালুক নেকড়ে বুনো মোষ অজগর, কী নেই! দিনে দুপুরে সেখানে ঘোর অন্ধকার। বিশাল বিশাল গাছ, লতাপাতা, বিছুটিবন, চোর বালি, দহ সবই সেখানে আছে।”
হেরম্ব বললেন, “কী সর্বনাশ! হেতমগড়ের জঙ্গল যে সর্বনেশে জায়গা! আমি পুরস্কার ডবল করে দিলাম। তোমরা সব বেরিয়ে পড়ো।”
শুনেই চররা বাই-বাই করে ছুটল।
হেতমগড়ের জঙ্গলে নবতারণ দারোগাও খবরটা শুনলেন। শুনেই কোমরবন্ধটা আরো একটু কষে এটে নিয়ে পঞ্চাশটা বৈঠকি আর পঞ্চাশটা বুকডন দিয়ে ফেললেন। সেপাইরা জঙ্গল ঢুড়ে-চুড়ে হেদিয়ে পড়েছিল, খবর শুনে তারাও চাঙ্গা হয়ে উঠল।
ওদিকে প্রথম চোটে জঙ্গলে ঢুকেই মাধব জায়গাটার খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন, এমন বিচ্ছিরি গহন আর অন্ধকার জঙ্গল তিনি দেখেননি জীবনে।
সবার আগে বনমালী, তারপর রেলগাড়ির কামরার মতো এ ওর কোমর ধরে প্রথমে মাধব এবং বনমালীর স্যাঙাতরা। ঘটোৎ মাধবের কাঁধে উঠে বসে আছে।
বেশ যাচ্ছিল সবাই। এর মধ্যেই হঠাৎ পিছন থেকে খাই-খাউ করে কুকুরগুলো তেড়ে এল। প্রাণের ভয়ে রেলগাড়ি ভেঙে যে যার মতে দৌড়োতে লাগল।
একটু বাদেই মাধব দেখেন, তার সঙ্গীদের চিহ্নও নেই। ঘটোৎ কচকে কাঁধে নিয়ে তিনি একা বেকুবের মতো ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। এই জঙ্গলে পুলিস তাকে খুঁজে পাবে না ঠিকই, কিন্তু তিনি নিজেও যে নিজেকে খুঁজে পাবেন মনে হচ্ছে না।
এই সময়ে হুপ করে ঘটোৎকচ কঁধ থেকে নেমে মাধবের দিকে নিজের লেজটা বাড়িয়ে দিল। ইঙ্গিত বুঝে মাধব লেজটা দুহাতে চেপে ধরলেন।
ঘটোৎকচ শাল, শিশু, সেগুন, জিকা, বাবলা–হাজারো গাছ গাছালি আর ঘন ঝোঁপঝাড় এবং লতাপাতার ভিতর দিয়ে মাধবকে নিয়ে চলল। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা মাধব বুঝতে পারলেন না, তবে ঘটোৎ যে বুদ্ধি করে ঠিক জায়গাতেই তাকে নিয়ে তুলবে এ বিষয়ে তাঁর সন্দেহ নেই। দু-একবার লতায় পা জড়িয়ে আছাড় খেলেন মাধব। তবে ঘন ঝোঁপঝাড়ে পড়ে যাওয়ায় চোট পেলেন না। কাঁটা-গাছে লেগে গা দু-চার জায়গায় চড়ে গেল। শুয়ে পোকার হুল লেগে ঘাড়টা জ্বালা করতে লাগল। তবে এরকম ছোটখাটো বিপদ ছাড়া বড় কোনো অঘটন ঘটল না। জঙ্গলের জীব ঘটোৎকচ খুব সাবধানেই নিয়ে যেতে লাগল তাঁকে।