মানুষ তিনি নন। তাই জামাইয়ের গ্রেফতারের খবরে তিনি খুশিই হয়েছেন। তিনি বলে পাঠিয়েছেন, কাল সকালের মধ্যেই মাধব চৌধুরীকে পুলিসের পাহারায় গ্রেফতার অবস্থায় শ্বশুরবাড়িতে যেন হাজির করা হয়।”
নবতারণ মাথা চুলকোতে চুলকোতে টাকের ছাল তুলে ফেললেন প্রায়। হেঃ হেঃ করে বিনয়ের হাসি হেসে বললেন, “কিন্তু মুশকিল হল, আমরা যখনই শুনলাম যে, তিনি বিজয়পুরের ছোট জামাই, তক্ষুনি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। উনি ত এখন থানায় নেই।”
নায়েব আরো গম্ভীর হয়ে বললেন, “তাহলে আবার এক্ষুনি তাকে গ্রেফতার করে আনুন। কাল সকালে তাকে গ্রেফতার অবস্থায় বিজয়পুরে হাজির না করলে কর্তা খুবই রেগে যাবেন। কারণ, তার ছোট মেয়ে বলে দিয়েছে, তার স্বামীকে আর তিন দিনের মধ্যে হাজির না করতে পারল সে বিষ খাবে বা গলায় দড়ি দেবে। জমি দারেরই মেয়ে তো, ওদের কথার নড়চড় হয় না। আপনি আর দেরি না করে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ুন। ঠিকমতো জামাইকে হাজির করতে পারলে কর্তা প্রচুর পুরস্কার দেবেন।”
এই বলে নায়েবমশাই উঠে পড়লেন।
নবতারণ বসে বসে টাক চুলকোতে লাগলেন। জীবনেও এমন মুশকিলে পড়েননি। কিন্তু কিছু একটা করতেই হবে। বিজয়পুরের জমিদারের সঙ্গে হর্তাকর্তাদের খুব খাতির। চটে গেলে নবতারণের চাকরি খেয়ে নিতে পারেন।
ওদিকে থানার গারদে ঘটোৎকচ প্রচণ্ড হম্বিতম্বি করছে। তার খাওয়ার সময় পার হয়ে গেছে, ঘুমও পেয়েছে। কিন্তু বাঁদরকে খাবার দেওয়ার কথা কারও মনে পড়েনি। তাছাড়া কুটকুটে কম্বলের
বিছানায় শুয়ে থাকা ঘটোৎকচের অভ্যাস নেই। ফলে সে ঘন ঘন হুঙ্কার ছাড়ছে, গরাদ বেয়ে উঠছে, নামছে। সে একটু মোটাসোটা বলে গরাদের ফাঁক দিয়ে বেরোতেও পারছে না। তবে তার মধ্যেই সে ঠ্যাং বাড়িয়ে একজন সেপাইকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে। আর একজনের চুল খামচে আচ্ছা করে মাথাটা ঠুকে দিয়েছে লোহার দরজায়। সেপাইরা রেগে গেলেও কিছু বলেনি, কারণ দারোগাবাবুর ছেলের জন্য বাঁদরটাকে নিয়ে যাওয়া হবে।
বাদরের হুপহাপ শুনে নবতারণ হঠাৎ গর্জন করে বললেন, “সব দোষ বেয়াদপ বাঁদরটার। নিয়ে আয় তো ওকে, আচ্ছাসে ঘা কতক দিই।”
সঙ্গে-সঙ্গে সেপাইরা ঘটোৎকচকে আচ্ছাসে দড়ি দিয়ে বেঁধে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এল। ঘটোৎকচ জানে, এই অবস্থায় তেড়িমড়ি করা ঠিক নয়। তাই সে খুব লক্ষ্মী ছেলের মতো কোনো গোলমাল করল না। এমনকী, সামনে হাজির হয়ে সে দারোগাবাবুকে হাতজোড় করে একটা নমস্কারও করল।
নবতারণ একটু নরম হয়ে বললেন, “ব্যাটা সহবত জানে দেখছি!” শুনে ঘটোৎকচ নবতারণকে একটা সেলামও দিল। “বাঃ বাঃ!” খুশি হলেন নবতারণ।
উৎসাহ পেয়ে ঘটোৎকচ নিজের কান ধরে জিব বের করে খুব অনুগমনের ভঙ্গি করল।
নবতারণ বহুক্ষণ বাদে মৃদু-মৃদু হাসতে লাগলেন।
ঘটোৎকচ তখন কান ধরে ওঠবোস করল, মাটিতে উবু হয়ে নাকে খত দিল, তারপর লজ্জার ভান করে দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে রাখল।
নবতারণ এইসব কাণ্ড দেখে এত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, বড়বাবু তায়েবজি আর অক্ষয় খাজাঞ্চি যে কখন ঘরে ঢুকে পড়েছেন তা টের পাননি।
বড়বাবুও জমিদার ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর তেমন হাকডাক নেই। নরম মানুষ বলে তাঁকে কেউই তেমন ভয়ও খায় না। উল্টে তিনিই বরং অনেক কিছুকে ভয় খান। দারোগা-পুলিসকেও তার ভীষণ ভয়।
তাই ভয়ে-ভয়ে থানায় ঢুকে গলা খাঁকারি দিয়ে অনেকবার দারোগাবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। তাতে কাজ হল না দেখে খুব ভয়ে-ভয়ে নবতারণের আর একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “ইয়ে, আমার শালা মাধব চৌধুরীকে কি গ্রেফতার করা হয়েছে?”
নবতারণ একটু চমকে উঠে আপাদমস্তক বড়বাবুকে দেখে নিলেন। তারপর ব্যঙ্গ-হাসি হেসে বললেন, “চালাকি করার আর জায়গা পেলেন না? মাধব চৌধুরী আপনার শালা হতে যাবেন কেন? তিনি তো বিজয়পুরের জমিদারের ছোট জামাই।”
বিজয়পুরের জমিদারের জামাই তাঁর শালা হতে পারবে না কোন্ যুক্তিতে তা বুঝতে না-পেরেও বড়বাবু নবতারণকে চটাতে সাহস পেলেন না। বললেন, “সে কথা অবশ্য ঠিক।”
নবতারণ মৃদু হেসে বললেন, “তবেই বুঝুন, চালাকি দিয়ে কোনো মহৎ কাজ সিদ্ধ হয় কিনা।”
“আজ্ঞে না।” বড়বাবু হতাশ হয়ে বললেন।
অক্ষয় খাজাঞ্চি অবশ্য গলায় একটু সন্দেহ রেখেই বললেন, “তবে কিনা অনেকের এমন জামাইও আছে যারা কিনা আবার অন্য কারো শালাও।”
তায়েবজিও খুব বিনয়ের সঙ্গে অক্ষয় খাজাঞ্চিকে সমর্থন করে বলল, “এই তো আমারই এক শালা আছে যে কিনা ঘুরঘুটপুরের ঘুসুরামের জামাই।
নবতারণ কটমট করে তায়েবজির দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিলেন, “এরকম সব হয় নাকি?”
অক্ষয় খাজাঞ্চি মিনমিন করে বললেন, “কাজটা হয়তো বেআইনি। এরকম হওয়া উচিতও নয়। তবে হচ্ছে, আকছার হচ্ছে।”
কোথাও একটা ভুল হচ্ছে বুঝতে পেরে নবতারণ গর্জন করে বললেন, “দাঁড়ান মশাই, প্যাঁড়ান! ব্যাপারটা একটু বুঝে নিই। মাধব চৌধুরী হলেন বিজয়পুরের বড়কর্তার জামাই, তার মানে উনি বড় কর্তার মেয়েকে বিয়ে করেছেন। তাহলে উনি হলেন বড়কর্তার ছেলেদের সম্পর্কে শালা।”
বড়বাবু জিব কেটে বললেন, “আজ্ঞে না, উনি সেক্ষেত্রে হবেন ভগ্নীপতি।”
“বললেই হল?”
নবতারণ আবার কটমট করে তাকান। তারপর একটু ভেবেচিন্তে বললেন, “না হয় তাই হল। কিন্তু শালাটা তাহলে কী করে হচ্ছেন?”