ঠিক এই সময়ে কানে কানে কে যেন বলে দিল, “রামের কথা ভাবছ তো! খিকখিক! তা ভাল, খুব কষে রাম-নাম করে যাও, কিন্তু তাতে লাভ নেই।”
মাধব হিম হয়ে গেলেন। তাকিয়ে দেখেন, নাকের ডগায় নন্দ কিশোর মুনসি।
নন্দকিশোর বলে, “ওসব লোকে রটিয়ে বেড়ায়। ভূতের নামে কত যে মিথ্যে কথা রটায় লোকে, তার লেখাজোখা নেই। বলে, রাম-নাম করলে নাকি ভূতে ভয় পায়। খিকখিক।”
মাধবের গলায় কথা সরছিল না। তবু কাঁপা-কাঁপা স্বরে বললেন, “তবে ভূতে কিসে ভয় খায়?”
নন্দকিশোর খুব খিকখিক করে হাসে। বলে, “তোমারও যেমন বুদ্ধি! ভূতে কিসে ভয় খায় সেই গুহ্যকথা আমি তোমাকে বলতে যাব কেন হে!”
“আমার যে ভীষণ ভয় করছে!” মাধব বলেন।
“তুমি মুখ, তাই ভূতকে ভয় খাও! গাছের ওপর তোমাকে কত করে বোঝালাম যে, ভূতের একরত্তি ক্ষমতা নেই, তাই তাকে ভয় খাওয়ারও কিছু নেই। আবার ভূতকে ভয় খাওয়ানোও ভারী শক্ত। ভূতকে মারা যায় না, তা তো নিজেও দেখলে। ভূতের সাপের ভয় নেই, চোরডাকাত বা পুলিসের ভয় নেই, বন্দুক বা তলোয়ারেও ভয় নেই, এমনকী সবচেয়ে বড় কথা কী জানো?”
“কী?”
“সবচেয়ে বড় কথা হল, ভূতের আবার ভূতের ভয়ও নেই। আর রামের মতো ভালমানুষকে আমরা ভয় পেতে যাবই বা কেন? রাম তো আর ভূতের নিদান দিয়ে যাননি। তাঁর আরও অনেক গুরুতর কাজ ছিল।”
মাধব ভয়ে ভয়ে বললেন, “তাহলে রাম-নাম করে লাভ নেই বলছেন?”
“লাভ একেবারে নেই তা বলিনি। রাম-নামে পাপ-তাপ কাটে, মনটা উঁচুতে ওঠে, প্রাণটা বড় হয়, ভক্তিভাব আসে, গায়ে শক্তিবৃদ্ধি হয়, মনোবল বাড়ে। কিন্তু তা বলে রাম-নাম করে আমাকে ভয় খাওয়াতে পারবে না।”
শক্ত পাল্লায় পড়েছেন বুঝতে পেরে মাধব কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললেন, “আপনাকে চড় মারাটা আমার ভারী অন্যায় হয়েছিল।”
নন্দকিশোর খিকখিক করে হেসে বলে, “আরে দূর দূর! তুমিও যেমন! তুমি তো চড় মারতে গিয়েছিলে, নবতারণ দারোগা পিস্তল বের করেছিল। খিকখিক! সাধে কি তোমাদের মূর্খ বলি? তোমার চড় আমার লাগলে তো? আমি কিছু মনে করিনি। তবে তোমার মতো চোর-জোচ্চরদের শাস্তি হওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি। সেইজন্যই আমি চেয়েছিলাম নবতারণকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসে তোমাকে ধরিয়ে দেব। কিন্তু দারোগা এমন ভয় খেয়ে গেল যে, পালিয়ে বাঁচে না।”
“আজ্ঞে আমি চোর নই। বিশ্বাস করুন।”
নন্দকিশোর গম্ভীর হয়ে বলল, “কোনো চোরই নিজেকে চোর বলে স্বীকার করে না। তুমি চোর কি না তা জানতে হলে আমাকে তোমার ভিতরে ঢুকতে হবে।”
“অ্যাঁ” বলে আঁতকে ওঠেন মাধব।
নন্দকিশোর বলে, “ভয়ের কিছু নেই। যাব আর আসব। দশ মিনিটও লাগবে না।”
নন্দকিশোর ভূত হলেও বিঘত খানেক লম্বা এবং ভাল সাইজের মর্তমান কলার মতোই পুরুষ্ট। মাধব কঁকিয়ে উঠে বললেন, “ভিতরে গিয়ে দেখবেনটা কী?”
“তোমার মগজ দেখব, বিবেক দেখব, তোমার মনটা কেমন তা বিচার করব, তারপর বুঝব তুমি চোর কি না।”
“কোথা দিয়ে ঢুকবেন?”
“নাক কান মুখ সব পথেই ঢোকা যায়। তবে নাক কান হচ্ছে গলিপথ। আমি গলি দিয়ে যাতায়াত পছন্দ করি না। মুখ হল রাজপথ। আমি রাজপথই পছন্দ করি। তুমি হাঁ করে।”
মাধব ইতস্তত করে বলেন, “গলায় যদি আটকে যায়, তাহলে তো বিষম খেয়ে মরব। আমি বলি কী, পুরোটা একসঙ্গে না ঢুকে আমি বরং আপনাকে একটু-একটু করে চিবিয়ে খেয়ে নিই।”
“দূর দূর! তুমিও যেমন! হাঁ করে থাকো, টেরই পাবে না। আমি এমন কায়দায় ঢুকে যাবে।”
অগত্যা মাধবকে হাঁ করতে হল। নন্দকিশোর ডাইভ মেরে ভিতরে ঢুকে গেলেন। মাধব টের পেলেন একটা নরম আইসক্রীমের মতো ঠাণ্ডা জিনিস তার টাগরীয় গোঁত্তা মেরে গলা দিয়ে নেমে গেল। বেশ বড় রকমের একটা ঢেকুর তুললেন মাধব। তারপর কাঠ হয়ে বসে রইলেন।
ছেলেবেলায় হাঁ করে কঁদতে গিয়ে একবার একটা মাছি গিলে ফেলেছিলেন মাধব। দুধ খেতে গিয়ে মাঝে-মাঝে এক-আধটা পিঁপড়েও পেটে গেছে। আহাম্মক মশা অনেক সময় বে-খেয়ালে
মানুষের মুখে ঢুকে গিয়ে পেটসই হয়ে যায়, তাই জীবনে বেশ কয়েকটা মশাও হয়তো মনের ভুলে গিলে ফেলেছেন তিনি। তাছাড়া ওষুধের বড়ি, চিরতার জল, তেতো পাঁচন সবই খেয়েছেন। কিন্তু ভূত-গেল। এই তার প্রথম। নন্দকিশোরকে গিলে ফেলার পর তিনি স্তম্ভিত হয়ে ভাবতে লাগলেন, এ আমি কী করলাম?
ওদিকে নবতারণ হতাশ হয়ে সদলবলে থানায় ফিরেই দেখলেন একজন গোঁফওয়ালা ভারী চেহারার বিশিষ্ট ভ ভদ্রলোক বসে আছেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “আমি হচ্ছি বিজয়পুরের জমিদারের নায়েব। খবর পেয়েছি, জমিদারমশাইয়ের ছোট জামাই মাধব চৌধুরীকে এই থানায় আটক রাখা হয়েছে। খবরটা কি সত্যি?”
বিজয়পুরের জমিদারের জমিদারি এখন আর নেই বটে, কিন্তু তাঁরা তিনটে জাহাজের মালিক, তামাকপাতার মস্ত ব্যবসা আছে, আরে হাজার রকমের কারবারে তাদের লাখ-লাখ টাকা খাটছে। তাদের ভয়ে বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খায়। সুতরাং নবতারণ মাথা চুলকোতে লাগলেন। এই থানার চার্জ নিয়ে এক দিনেই এই বিপত্তি দেখে তিনি অন্য থানায় বদলি হওয়ার কথাও ভাবলেন। তারপর কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “তাকে কি ছেড়ে দেওয়ার হুকুম আছে?”
নায়েবমশাই গম্ভীর হয়ে বললেন, “না। বরং তাকে খুব ভাল করে আটকে রাখবেন। কারণ, লোকটা খুবই খ্যাপাটে আর রাগী। বিয়ের রাতে তাকে শালীরা সুপুরিশুদ্ধ নাড়, খেতে দিয়েছিল বলে তিনি রাগ করে চলে আসেন, আর কখনো শ্বশুরবাড়িতে যাননি। জমিদারমশাইও ওরকম আহাম্মক জামাইয়ের মুখদর্শন করতে চাননি। কিন্তু এখন মেয়ের কান্না-কাটিতে তার মন নরম হয়েছে। কিন্তু জামাইয়ের হাতে-পায়ে ধরে যেচে সেধে তাকে নিয়ে যাওয়ার