মাধববাবু হুংকার দিয়ে বললেন, “ফের তস্কর বললে এক থাপ্পড়ে তোমার মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেব।”
নন্দকিশোর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “দাদারে, সেই সুখের দিন কি আর আছে? আমাকে থাপ্পড় মারা অত সোজা নয়।”
“বটে!” বলে মাধববাবু গর্জন করে করাল চোখে চারদিকে চেয়ে লোকটাকে খুঁজতে লাগলেন।
“এই তো আমি। এই যে একটু বাঁয়ে ঘেঁষে তাকালেই দেখতে পাবেন।” বলে নন্দকিশোর নিজের অবস্থানটা জানাতে থাকে মাধবকে।
বাঁয়ে তাকিয়ে মাধব দেখেন, গাছের ফোকর দিয়ে আসা একমুঠো জ্যোৎস্নায় বিঘতখানেক লম্বা তুলোর আঁশের মতো একটা জিনিস বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভাসতে-ভাসতেই তিড়িক করে লাফিয়ে মাধবের নাকের ডগায় এসে নাচতে-নাচতে বলল, “মারবে থাপ্পড়? মারে না দেখি!”
তা মাধব মারলেন! জীবনে কাউকে এত জোরে আর এত রাগের সঙ্গে থাপ্পড় মারেননি। সজোরে হাতটা বাতাস কেটে বই করে ঘুরে এল আর সেই থাপ্পড়ের টানে মাধব নিজেও ঘুরে গেলেন। এক পাক ঘুরলেন, দু পাক ঘুরলেন, তারপর ঘুরতে-ঘুরতেই মাচান থেকে এরোপ্লেনের মতো ভেসে পড়লেন, শূন্যে।
দমাস করে বিরাট এক শব্দ। নবতারণের হাত থেকে টর্চটা ছিটকে গেল। কুকুর দুটো লেজ গুটিয়ে কেঁউ কেঁউ করে পালাল। পুটিরাম আর ভজহরি গাছের মাঝবরাবর পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। হঠাৎ আঁতকে ওঠায় তারাও হাত-পা ফস্কে নীচে পড়ল। গাছের তলায় অন্ধকারে সে এক হুলস্থুল কাণ্ড। গাছের ওপর ঘুমন্ত পাখিরা ঘুম ভেঙে আতঙ্কে কা-কা ক্যাচর-ম্যাচর করতে লাগল।
নবতারণ মূৰ্ছা গিয়েছিলেন। পনরো-বিশ ফুট উঁচু থেকে দেড়-দু’ মনি জিনিস কারো ঘাড়ে পড়লে তার মূছ। যাওয়াটা কোনো কাপুরুষের লক্ষণ নয়। নবতারণ কাপুরুষ ননও। তবে তাঁর মতো শক্ত ধাতের মানুষ মূর্ছা যাওয়ায় সেপাইরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। ফলে অন্ধকারে কী যে ঘটে গেল তাদের নাকের ডগায়, তা তারা ভাল করে ঠাহর পেল না। তবে সকলেই কাজ দেখাতে এদিক-সেদিক ‘পাকড়ো পাকড়ো’ বলে দৌড়তে লাগল।
মিনিট পাঁচ-সাত বাদেই অবশ্য নবতারণ চোখ খুললেন। তবে যে নবতারণ চোখ খুললেন, তিনি আর আগের নবতারণ নন। এত কাহিল হয়ে পড়েছেন যে, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। গায়ে-গতরে প্রচণ্ড ব্যথা। চোখে সর্ষেফুল দেখছেন। খানিক বাদে একটু ধাতস্থ হয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলেন। কেউ কোথাও নেই। নিজের মাথাটা দু’হাতে চেপে ধরে আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে ঘোলাটে মগজটাকে সাফ করে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন নবতারণ, এমন সময়ে খুব কাছ থেকে কে যেন বলে উঠল, “ছ্যাঃ ছ্যাঃ, এইসব ননীর পুতুলকে আজকাল দারোগার পোস্টে প্রোমোশন দিচ্ছে নাকি? হু’, দারোগা ছিল বটে আমাদের আমলের নিশি দারোগা, একটা আস্ত কাঁঠাল খেয়ে ফেলত। গোটা খাসির মাংস হজম করত। সাত ফুট লম্বা ছাপ্পায় ইঞ্চি বুকের ছাতি, কিল দিয়ে পাথর ভাঙত।”
নবতারণের ঘোলাটে বুদ্ধি সাফ হয়ে গেল, গায়ের ব্যথাও গেল উবে। অপমানের জ্বালায় এক লাফে উঠে হুংকার ছাড়লেন, “কার রে এত সাহস, সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস?”
খিক করে একটু হাসির শব্দ হল। কে যেন বলল, “বেশি রোয়াবি দেখিও না। আমি কত বুদ্ধি খাঁটিয়ে চোরটাকে গাছ থেকে নীচে ফেললাম, আর তুমি তাকে কোলের মধ্যে পেয়েও ধরে রাখতে পারলে না। মাইনে নাও কোন লজ্জায়?”
নবতারণ খাপ থেকে রিভলভার বের করে বললেন, “সাহস থাকে তো সামনে এসে কথা বল।
“সাহসের কথা আর বোলল না। তুমি যা বীরপুরুষ, তাতে চামচিকেও তোমাকে ভয় খাবে না। আমি সামনেই আছি, কী করবে করো না।”
নবতারণ মহিষের মতো শ্বাস ফেলে, দাতে দাঁত পিষে জাঁতার মতো শব্দ করে বললেন, “কই তুই?”
“এই যে!” বলে বিঘত-খানেক লম্বা সাদাটে নন্দকিশোর মুনসি একেবারে নবতারণের নাকের ডগায় নাচতে লাগল। সঙ্গে খিকখিক করে হাসি।
নবতারণ চাঁদের ঘোলাটে আলোয় নিজের নাকের ডগায় এই অশরীরী কাণ্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন প্রথমটায়। তারপর পিছু ফিরে দৌড়োতে-দৌড়োতে চেঁচাতে লাগলেন, “পুটিম! ‘ভজহরি! ভূত! ভূত।”
কয়েক মিনিটের মধ্যে আমবাগান সাফ হয়ে গেল।
৪. বিপদ ঘটলে মানুষ
বিপদ ঘটলে মানুষ তখন-তখন যতটা ভয় পায়, তার চেয়ে আরও বেশি ভয় পায় বিপদ কেটে যাওয়ার পর সেই বিপদের কথা ভেবে।
মাধবেরও হয়েছে তাই। ভূতকে চড় মেরেছেন, গাছ থেকে নবতারণের ঘাড়ে পড়েছেন, তারপর অন্ধকারে অনেকটা পথ দৌড়ে গাছ-গাছালির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে, হোঁচট খেয়ে পড়ে, অতি কষ্টে নদীর ধারে পৌঁছে গেছেন। নদীর ধারে বসে জিরোতে জিরোতে গোটা ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে এখন হঠাৎ আতঙ্কে শিউরে উঠে কাঠ হয়ে গেলেন। সাক্ষাৎ পুলিস এবং সাক্ষাৎ ভূতের পাল্লা থেকে কপাল জোরে বেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু এখন ভয়ে শরীর আড়ষ্ট হয়ে যাওয়ায় আর এক পাও চলার ক্ষমতা ছিল না।
এমনই গ্রহের ফের যে, কিছুতেই ‘রাম’-নামটাও মনে আসছে না। দশরথ, লক্ষ্মণ, শত্রু, ভরত, এমনকী মন্থর নামও মনে পড়ছে, কিন্তু দশরথের বড় ছেলের নামটা জিবে আসছে না। বসে প্রাণপণে বিড়বিড় করছেন, “আরে ঐ যে দশরথের বড় ছেলেটা…আরে ঐ তো বনবাসে গিয়েছিল…সোনার হরিণের পিছু নিয়েছিল যে ছোঁকর …আহা কী যেন নাম…আরে ঐ তো রাবণরাজার সঙ্গে যুদ্ধ করল …হনুমানের খুব ভক্ত ছিল না না, হনুমানই সেই ছোঁকরার খুব ভক্ত ছিল…আরে দ্যাখো কাণ্ড, হরধনু ভঙ্গ করে সীতাকে বিয়ে করল যে লোকটা…”