“তাও ঠিক নয়।”
“তবে?”
“সে অনেক গুহ কথা। শুনলে ভয় পাবেন।”
“পুলিস ছাড়া আমি আর কিছুকে ভয় পাই না।” লোকটা আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, জবাব দিল না।
মাধব জিজ্ঞেস করলেন, “বড়-বড় শ্বাস ফেলছেন যে! দুঃখ-টুঃখ পেয়েছেন নাকি?”
“তা দুঃখ আছে বই-কী। বসে বসে ভাবি, মানুষের মতো মিথ্যে বাদী দুনিয়ায় দুটো নেই।”
মাধব এই বিপদের মধ্যেও কথাটা নিয়ে ভাবলেন। ভেবে বললেন, “সে ঠিক। তবে কিনা দুনিয়ায় মানুষ ছাড়া আর তো কেউ কথা বলতে পারে না, তাই মিথ্যেকথা বলার প্রশ্নও ওঠে না। তা আপনি কোন্ মিথ্যে কথাটা নিয়ে ভাবছেন?”
নন্দকিশোর একটু যেন খিক খিক করে হাসল। তারপর বলল, “ছেলেবেলায় গল্প শুনতুম ভূতের নাকি ঘরে বসে লম্বা হাত বাড়িয়ে বাগান থেকে লেবু ছিঁড়ে আনতে পারে। তারা নাকি মাছভাজা খায়। তারা নাকি মানুষের ঘাড়ে ভর করে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটায়।”
মাধবের গা একটু ছমছম করল। তবু সাহসে ভর করে বললেন, “আমিও শুনেছি।”
“দূর দূর! ডাহা মিথ্যে। ভূত হওয়ার পর আমি হাড়ে-হাড়ে বুঝেছি ভূতেদের কানাকড়ির ক্ষমতাও নেই। বাতাসের মতো ফিনফিনে শরীর নিয়ে কিছু করা যায় মশাই? আপনিই বলুন!”
এতকাল মাধবের ধারণা ছিল, তিনি পুলিস ছাড়া আর কাউকে ভয় পান না। এখন একেবারে কাঠ হয়ে বসে থেকে তিনি টের পেলেন, দুনিয়ায় আরো বিস্তর ভয়ের ব্যাপার রয়ে গেছে। কঁপা গলায় তিনি বললেন, “দোহাই মশাই, আমাকে আর ভয় দেখাবেন না। আমি ভূতকেও ভীষণ ভয় পাই।”
নন্দকিশোর গম্ভীর হয়ে বলে, “ভূতকে ভয় পায় মূর্খেরা। বললাম তো, ভূতেদের কানাকড়ির ক্ষমতাও নেই। থাকলে এক্ষুনি ঐ পুলিস গুলোকে ডেকে আপনাকে ধরিয়ে দিতে পারতাম। না হয় তো আপনাকে এই মাচান থেকে ঠেলে নীচে ফেলে দিতাম।”
মাধববাবু সভয়ে মাচার বাঁশ চেপে ধরে বললেন, “ওসব কী কথা? ফেলে দিলে হাড়গোড় ভাঙবে যে!”
“দূর মশাই।” নন্দকিশোর ধমক দিয়ে বলে, “বলছি না ফেলবার ইচ্ছে থাকলেও ক্ষমতা নেই!”
“কিন্তু যদি পুলিসকে ডাকেন?” মাধব সন্দেহে কাটা হয়ে বলেন।
“ডাকব কী? আমার গলার স্বর ওদের কানে যাবে বুঝি? আপনি যেমন! আমার কথা আমি নিজেও শুনতে পাই না।”
“তবে আমি শুনছি কী করে?”
“বিপদে পড়ে আপনার চোখ কান নাক ইন্দ্রিয় এবং স্নায়ু অত্যন্ত বেশি সজাগ হয়ে ওঠায় অনুভূতির ক্ষমতা খুব বেড়ে গেছে। আমার গলার স্বর বলে কিছুই নেই। আপনি যা শুনতে পাচ্ছেন তা হল একটা চিন্তার তরঙ্গ মাত্র। অন্য কোনো ভোতা লোক হলে কিছুই শুনতে পেত না।”
মাধববাবু এই দুঃসময়েও একটু খুশি হলেন। তিনি তাহলে তো লোক নন! গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “যথার্থই বলেছেন।”
নন্দকিশোরের আর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। সে বলে, “এ-বাগানে ফলনের সময় যত চৌকিদার পাহারায় থাকে, আমি তাদের সকলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কাজ হয়নি। যত চোর-ডাকাত এসে এখানে গা-ঢাকা দেয় তাদেরও অনুভূতি বলে কিছু নেই। আজই প্রথম একটা চোরকে দেখলাম যে আমার কথা শুনতে পেল।”
“চোর?”
নন্দকিশোর নির্বিকারভাবে বলে, “চোর বললে যদি রাগ হয় তবে না হয় তস্করই বললাম। কিন্তু আপনার মতো ভিতু লোক যে ডাকাত বা গুণ্ডা হতে পারে না তা আমি দেখেই বুঝেছি।”
মাধববাবু একটু রেগে গিয়ে বলেন, “আমি ওসব কিছুই নই। আমি হচ্ছি হেতমগড়ের মেজকুমার। পুলিস আমাকে বিনা দোষে ধরেছিল। আমি পালিয়ে এসেছি।”
নন্দকিশোরের খিকখিক গা-জ্বালানো হাসি শোনা যায়। সে বলে, “সে কথা পুলিসকে বলে দেখবেন বরং। ঐ তারা এসে গেছে।”
মাধব নীচের দিকে চেয়ে কাঠ হয়ে যান। আবছা অন্ধকারে দেখতে পান গোটা-দুই কুকুর গাছের তলায় ঘুরঘুর করে কী যেন শুকছে। তার চটিজোড়া নয় তো?
এই সময়ে একটা জোরালো টর্চের আলো পড়ল গাছতলায়। নবতারণ বাজখাই গলায় বললেন, “এই গাছে একটা বিটলে আছে। ওরে, তোর বন্দুক উচিয়ে থাক। পুটিরাম আর ভজহরি গাছে ওঠ।”
মাধববাবুর যখন সাঙ্ঘাতিক বিপদ তখনো নন্দকিশোর পিছন থেকে বলল, “আপনি দেখছি চোর হিসেবেও নিতান্তই কাঁচা। চটিজোড়া গাছতলায় ছেড়ে এসেছেন! অ্যাঁ? আর আমি ভাব ছিলাম আপনি ভোতা লোক নন!”
মাধববাবু আর সহ্য করতে পারলেন না। জমিদারদের রক্ত এখনো তার গায়ে আছে। এই সেদিনও তার ঠাকুর্দা রাগ হলে গাছে চড়ে বসে থাকতেন। তিনি না রেগেই গাছে চড়েছেন বটে, কিন্তু এখন গাছে চড়ার পর তার রাগটাও হল। সারাদিন আজ নানারকম
পা গেছে, তার ওপর এখন বিপদের মুখে আবার ভূতের অপমান! মাধব গর্জন করে বললেন, “চটি ছেড়ে আসব না তো কি কেঁচড়ে করে নিয়ে আসব? জানেন, আমাদের বংশে কেউ কখনো নিজের চটি নিজে পরেনি বা নিজে ছাড়েওনি? বাইশজন চটি-বরদার ছিল আমাদের, বিশ্বাস হয়? আমার বাবার পা থেকে জুতো খোলর লোক ছিল না বলে তিনি শ্বশুরবাড়িতে এক রাত্রি জুতো পায়ে বিছানায় শুয়েছিলেন। তা হলে বুঝুন আমি কার ছেলে, কোন্ বংশের লোক! আমরা কখনো নিজের চটি নিজের হাতে ছুঁই না। তা জানেন?”
নন্দকিশোর মোলায়েম গলায় বলে, “চটির কথাটায় আপনার খুব লেগেছে দেখছি। আমি কিন্তু আপনাকে চটি নিয়ে খোঁটা দিইনি। বলছিলাম, চুরি-চামারি করতে গেলে অতলপেটা-বাবু সেজে বেরোলে কি হয়? চটি পরে কেউ চুরি করতে যায়? এ হচ্ছে অতিশয় কাঁচা তস্করের কাজ।”