মাধববাবু ভয়ে ভয়ে বললেন, “অনেকটা আমারই।”
“বাঁদরটাকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। এর এগেইনটে একটা ফুটবল চুরির কেস আছে। আজ রাতে একে হাজতেই রাখা হবে। আপনার বাড়ি চলে যান। কাল সকালে এসে খোঁজ নেবেন।”
এই বলে হেড কনস্টেবল তাদের নিয়ে গিয়ে পিছনের ফটক খুলে রাস্তায় বের করে দিল। বলল, “এরপর থেকে নিজের বাঁদরকে ভাল করে বেঁধে রাখবেন।”
“যে আজ্ঞে,” বলে মাধববাবু খুব অমায়িকভাবে হাসলেন।
হেড কনস্টেবল ফটক বন্ধ করে দিয়ে অন্য সেপাইদের হাঁক দিয়ে বলল, “বাঁদরটাকে আলাদা সেলে ভরে দে। আর দেখ তো, ঐ পাঁচটা বদমাশ কয়েদি কোনো বদ মতলব ভাজছে কি না”।
ততক্ষণে পাঁচ কয়েদি চেঁচা দৌড়ে পগার পার হয়েছে। পাতুগড়ে আমবাগানের অন্ধকারে ঢুকে হাঁফ ছেড়ে বনমালী হেসে বলল, “বাঁচা গেল।”
মাধববাবু তেমন খুশি নন। ঘটোৎকচের জন্য মনটা খারাপ। বললেন, “আমাদের জন্যই বেচারা ধরা পড়ে গেল, নইলে ঠিক পালাতে পারত।”
কেউ তার কথায় জবাব করল না। সবাই হাঁফাচ্ছে। তা ছাড়া বিপদ এখন তো কাটেনি। দৌড়তে-দৌড়তে থানা থেকে খানিক দূর আসতে না আসতেই পাগলান্টির শব্দ শোনা গেছে। খুব একটা হৈ-চৈ আর হুড়োহুড়ির শব্দও পাওয়া যাচ্ছিল পিছনে।
পাতুগড়ের আমবাগান বিখ্যাত জায়গা। এখানে একশো দেড়শো বছরের পুরনো বিস্তর বড়-বড় আমগাছ আছে এবং সেগুলো এখনো মাঝে মাঝে ফল দেয়। তা ছাড়া বড়বাবু কলমের বাগানও করেছেন। বিশাল একশো বিঘার মতো বাগানটার পুরোটাই নানা ঝোঁপঝাড়ে ঘেরা। আম-চুরি ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন গাছে মাচা বাঁধা আছে। মাচায় ফলনের সময় লোকজন থাকে। আগে বড়বাবুর বাবা-ঠাকুর্দা নিজেরাই আম পেড়ে বেচে দিতেন। বড়বাবু আর সে ঝামেলায় না গিয়ে প্রতি বছর বাগানটা বন্দোবস্তে দিয়ে দেন।
বাগানে ঘোর অন্ধকার। ভুতুড়ে কুয়াশায় চারদিকটা ছেয়ে আছে। ভাঙা বাতাসার মতো একটু উঁদও উঠেছে আবার। তাতে চারদিকটা আরো গা-ছমছম হয়ে আছে। শীতকাল বলে আমবাগানে লোকজন নেই।
মাধব ডাকলেন, “বনমালী!”
“আজ্ঞে!”
“এখন কী হবে?”
“কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে থাকতে হবে। তাপটা কেটে যাক তারপর যা হয় করা যাবে।”
“এখানে পুলিস আসবে না তো?”
বনমালী মাথা চুলকে বলে, “তা আসবে। যত চোর-ছ্যাচড় ডাকাত পুলিসের চোখে ধুলো দিতে এই আমবাগানেই আসে। পুলিসও সেটা ভালই জানে।”
মাধব ভয় খেয়ে বলেন, “তাহলে? আমার যে আবার পুলিসের ভয়টাই সবচেয়ে বেশি।”
বনমালী হেসে বলে, “পুলিস এলেই বা কী? এই আমবাগানের মতো এত ভাল চোর-পুলিস খেলার জায়গা আর কোথায় পাবেন?”
মাধব আবার ডাকলেন, “বনমালী!”
“আজ্ঞে।”
“খিদে পায় যে!”
“একটু চেপে থাকুন। ওধার থেকে টর্চ লাইটের আলো দেখা যাচ্ছে। পুলিস এল বোধহয়।”
বনমালীর স্যাঙাতরা ওস্তাদ লোক। পুলিসের গন্ধ পেয়েই টপাটপ এক-একটা গাছে চড়ে অন্ধকারে গায়েব হয়ে গেল। বনমালী মাধবকে আর-একটা গাছে ঠেলে তুলে দিয়ে বলল, “একটু ঠাহর করে উঠে যান। এ-গাছের মাচা খুব উঁচুতে নয়। আমি ধারে-কাছেই আর একটা গাছে থাকব। দেখবেন কর্তা, দয়া করে ডাকাডাকি করবেন না। বিপদে পড়লে লুকোচুরি খেলার টু দেওয়ার মতো আস্তে করে টু দেবেন।”
এই বলে বনমালীও হাওয়া হয়ে গেল।
মাধব পুলিসের আতঙ্কে প্রাণভয়ে গাছে চড়তে লাগলেন। অনেককাল এসব কর অভ্যাস নেই। তাই হাত-পায়ের চামড়া ছড়ে
গেল গাছের ঘষটানিতে। চটিজোড়া খসে পড়েছিল পা থেকে, সেটা আর তোলা হল না। অন্ধকারে ঠাহর করে করে মোটা মোটা ডাল বেয়ে খানিকটা উঠে মৃদু জ্যোৎস্নায় একটা বাঁশ আর বাখারির মাচান পেয়ে গেলেন। বিশেষ মজবুত বলে মনে হল না। উঠতেই খচমচ শব্দ করে দুলতে লাগল। গত বর্ষার জলে দড়ির বাঁধনগুলো পচে গিয়ে থাকবে। মাচানে বসে প্রতি মুহূর্তে পড়ে যাওয়ার চিন্তা করতে-করতে মাধববাবু একটা টু দিলেন। কিন্তু দেখলেন, ভয়ে আর তেষ্টায় গলা শুকিয়ে থাকায় শব্দ হল না, শুধু ফুঃ করে একটা হাওয়া বেরিয়ে গেল।
চারদিকে কী হচ্ছে তা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না মাধববাবু, কিন্তু লোকজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। কাছেপিঠে একটা জোরালো টর্চের আলো জ্বলে উঠে নিবে গেল। গোটা তিন-চার কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল হঠাৎ। মাধববাবু সিটিয়ে বসে রইলেন। গাছের ওপর শীত আরো বেশি। কনকনে ঠাণ্ডায় হাত পায়ে সাড় নেই। তার মধ্যে আবার টুপটাপ করে শিশিরের ফোঁটা গায়ে পড়ে ঘঁক করে উঠছে। ঘোলাটে অন্ধকারে দেখা গেল না, কিন্তু কী একটা লম্বা-মতো মাধববাবুর পায়ের পাতার ওপর দিয়ে সোত করে সরে গেল। নীচে থেকে কে হাক দিল, “বড় গাছগুলো ঘিরে ফেল।”
মাধববাবু এবার প্রাণপণের চেষ্টায় একটা টু দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে খুব কাছ থেকেই কে যেন পাল্টা টু দিল। কিন্তু চারদিকে চেয়ে মাধববাবু কাউকে দেখতে পেলেন না। আবার টু দিলেন। আবার টু ফেরত এল। তারপরেই একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। খুবই কাছে, প্রায় তাঁর ঘাড়ের ওপর খাসটা পড়ল। মাধববাবু চাপা স্বরে বললেন, “কে রে? বনমালী নাকি?”
সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল, “না, বনমালী নয়।”
“তবে?”
“চিনবেন না। আমি হলাম নন্দকিশোর মুনসি।”
মাধব লোকটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু এই আলো আঁধারিতে কিছু ভাল করে দেখাও যায় না। না দেখলেও একটা লোক কাছে আছে জেনে মাধব খুব ভরসা পেয়ে বললেন, “ফেরারি নাকি?”