আগাগোড়া কালো পোশাক এবং কালো মুখোশ পরা মাস্টার লখিন্দর এসে ঢুকল। ভারী চটপটে তার হাঁটার ভঙ্গি। চওড়া কাধ, সরু কোমর, আঁট পোশাকের ভিতর দিয়ে শরীরের শক্ত বাঁধুনি দেখা যাচ্ছে।
খাঁচার ওপরের লোকটা দরজাটা ওপর দিকে টেনে তুলতে না-ভুলতে বিশাল সাপটা বিদ্যুৎগতিতে বেরিয়ে এল বাইরে। লখিন্দর তখনো দর্শকদের অভিবাদন শেষ করেনি। ঠিক এই অপ্রস্তুত মূহুর্তে বিশাল গোখরো লখিন্দরের পিঠ সমান উঁচু ফণা তুলে সাঁই করে চাবুকের মতো ছোবল দিল।
সেই দৃশ্য দেখে আর সকলের মত চোখ বুজে ফেলল রামু। একটা মৃদু “গেল গেল এই রে, সব শেষ” গোছের আওয়াজও বেজে গেল চারদিকে।
০৬-১০. কুন্দকুসুম চোখ বোজেননি
সবাই চোখ বুজলেও কুন্দকুসুম চোখ বোজেননি। বরং তার চোখের পলক পড়ছিল না তাঁবুর চারদিকে যে “হায় হায়” ধ্বনি ভেসে গেল, তিনি তাতেও যোগ দিলেন না।
বিশাল রাজগোখরো যখন ছোবল দিল, তখন তার দিকে মাস্টার লখিন্দর পেছন ফিরে আছে। আর যে চাবুকের মতো গতিতে ছোবলটা এল, তা থেকে নিজেকে বাঁচানো খুব শক্ত কাজ।
কিন্তু তবু দেখা গেল, সাপটা যেখানে ছোবলটা চালাল সেখানে লখিন্দর নেই। লখিন্দর লাট্রর মতো একটা পাক খেয়ে কী করে যে সরে গেল এরেনার অন্য ধারে, সেটাই চোখ চেয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন কুন্দকুসুম।
ছোবল ফসকে যাওয়ায় সাপটাও বুজি হতভম্ব। আবার বিশাল ফণা তুলে কুটিল চোখে সাপটা দেখে লখিন্দরকে। কিন্তু ওস্তাদ লখিন্দর তখনো সাপটার দিকে পিছন ফিরে দর্শকদের হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে। যেন সে জানেই
যে তার পিছনে কালান্তক যমের মতো গোখরো।
আবার এরেনার ওপর বিদ্যুৎ খেলিয়ে সাপটা এগিয়ে গেল এবং শপাং করে ছোবল বসাল! এবার বাঁ পায়ের ডিমে।
সেই দৃশ্য দেখে দর্শকরা পাগলের মতো চেঁচাতে থাকে, “মরে গেল মরে গেল!”
লখিন্দর এবার সরেওনি ভাল করে। শুধু বাঁ পাটা একটু ছড়িয়ে দিয়েছিল
এক চুলের জন্য ছোবলটা পায়ে না-লেগে মাটি ছুঁয়ে উঠে গেল আবার।
“বন্ধ করো! এ সর্বনেশে খেলা বন্ধ করো!” বলে মহিলারা চেঁচাতে লাগলেন। চেঁচানোই স্বাভাবিক। লখিন্দর যে সাপটার দিকে তাকাচ্ছেই না।
সাপটা যখন তৃতীয় বার ছোবল তুলেছে, তখন লখিন্দর উবু হয়ে তার ডান পায়ের জুতোর ঢিলে-হয়ে যাওয়া ফিতে বাঁধছে মুখ নিচু করে। সুতরাং তার মাথাটা এবার একেবারে সাপের দোল-দোলন্ত ফণার সামনে।
“আর রক্ষে নেই গবাদা!” বলে রামু হাঁটু খিমচে ধরে।
এবার কুলকুসুমেরও চোখ বন্ধ করে ফেলতে ইচ্ছে হল। চোখের সামনে একটা নির্ঘাত মৃত্যু কার দেখতে ভাল লাগে!
সাপটা ফোঁস করে একটা ক্রুদ্ধ আওয়াজ ছেড়ে সটান লখিন্দরের মাথা লক্ষ করে হাতুড়ির মতো নেমে এল।
কিন্তু আশ্চর্য এই, বসা অবস্থাতেই লখিন্দর একটা ব্যাঙের মতো লাফিয়ে সরে গেল পিছনে। একবারও সাপটার দিকে না তাকিয়ে বসে বসে সে জুতোর ফিতেটা শক্ত করে বেঁধে নিল ভারী নিশ্চিন্তভাবে।
পুলিশের একজন ইনফরমার বৈরাগীর ছদ্মবেশে কুকুসুমের পিছনের বেঞ্চে বসে ছিল। কুন্দকুসুম একবার তার দিকে ফিরে ভ্রূ কুঁচকে মাথাটা একটু ওপরে তুললেন। অর্থাৎ লোকটা কে?
ইনফরমার চারদিকে চেয়ে দেখে নিল, কেউ তাকে লক্ষ করছে কিনা। কিন্তু এরেনায় যে খেলা চলছে, তার দিকে রুদ্ধশ্বাস চেয়ে মানুষ কেউ কারো দিকে তাকাতে ভুলেই গেছে। ইনফরমার মুখটা এগিয়ে এনে মৃদু স্বরে বলল, “জানি না। তবে এ ধরনের খেলা একসময় দেখাত গোবিন্দ ওস্তাদ। কিন্তু কাশিমের চরের সেই মার্ডার কেসে গতকাল তার ফাঁসি হয়ে গেছে।
“হয়ে গেছে?”
“হয়ে গেছে। গোবিন্দর ভাই জেলখানার গিয়ে মড়া নিয়ে শ্মশানে দাহ পর্যন্ত করেছে বলে খবর পেয়েছি।”
“মুখোশের আড়ালে লোকটা তাহলে কে একটু খবর নিও।”
“যে আজ্ঞে।”
ওদিকে এরেনায় মুখোশাবৃত লখিন্দর বারবার অবহেলায়, আনমনে ছোবল এড়িয়ে এড়িয়ে সাপটাকে হয়রান করে তুলল। অবশেষে সেই রাজগোখরো যখন ক্লান্তিতে ছোবল মারা মুলতুবি রেখে একধারে বিড়ে পাকিয়ে বিশ্রাম নিতে বসল তখন শেষ হল খেলা। জীবন ও মৃত্যুর এই বিপজ্জনক খেলা দেখে দর্শকরা এত জোর হাততালি দিল যা অন্য কোন খেলায় দেয়নি।
লখিন্দর একবার হাত তুলে সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল এরেনা থেকে।
রাত গভীর। সার্কাসের চত্বরে যে যার তাঁবুতে ঘুমোচ্ছ। জেগে আছে শুধু কয়েকজন চৌকিদার। আর জেগে আছে বুড়ো সামন্তর তাবুতে সামন্ত আর গোবিন্দ ওস্তাদ।
সামন্ত মৃদু স্বরে বলে, “এবার ঘটনাটা খুল বল।”
গোবিন্দ একটু হাসল। বলল, “কাল আমার ফাঁসি হয়ে গেছে। এমন কী, দাহকাজ পর্যন্ত সারা।”
সামন্ত তামাকের নলটা মুখ থেকে সরিয়ে বলে, “আর একটু খোলশা করে বল। তোকে ফাঁসি দেয়নি তো দিল কাকে?”
গোবিন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তা আমি জানি না। ফাঁসি হবে বলে জানিয়ে দিয়েছিল আমাকে। আমিও তার জন্য তৈরি ছিলাম। কিন্তু মাসখানেক আগে একদিন সকালে আমাকে যখন জেলখানার চত্বরে পায়চারি করাচ্ছিল, তখন দেখি কয়েকজন রাজমিস্ত্রি ভারা বেঁধে জেলখানার উঁচু ঘেরা দেয়ালে মেরামতির কাজ করছে।”
“তুই তখন কী করলি?”
“আজ্ঞে মাথায় তখন মতলবটা খেলে গেল। ভাবলাম, এই সুযোগ পরে আর পাব না। আমাকে দুজন বিশাল চেহারার সেপাই পাহারা দিচ্ছিল। আমি তাদের ঠাট্টা করে বললাম ঐ যে রাজমিস্ত্রি ভারা বেঁধেছে ওটায় উঠে যদি কোনো কয়েদি পালায় তবে কী করবে? ওরা বলল, অত সহজ নয়। তুই পারবি? আমি হেসে বললাম, চেষ্টা করতে পারি। ওরাও হাসল, বলল, কর না দেখি।”