লোকটা তার বাঁদুরে টুপিটা খুলে চাঁদর-ঢাকার মুখটা একটু ফাঁক করে আলোয় তুলে ধরে বলে, “আমি রে আমি। গোবিন্দ ওস্তাদ।”
লোকগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে আছে। লোকটা বলে কী? গোবিন্দ ওস্তাদ! তার তো আজ বাদে কাল ফাঁসি হওয়ার কথা।
গোবিন্দ আবার টপ করে টুপিটা কপালে টেনে, চাঁদরে মুখ ঢেকে ফেলল।
একজন তোতলাতে তোতলাতে বলল, “গোবিন্দদা। তোমার না ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল! ভুত হয়ে আসনি তো?”
আর একজন রামনাম করতে করতে কঁপা গলায় বলে, “সব ভুলে গেলে নাকি গোবিন্দদা?”
গোবিন্দ জবাব দিচ্ছিল না। খোলা দরজা দিয়ে তাবুর ভিতরে গোল জায়গাটা দেখছিল এক মনে। এই সার্কাসে সে বহু খেলা দেখিয়েছে। আপনা থেকেই তার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল।
জোয়ান-জোয়ান লোকগুলো তার দিকে তাকিয়ে আছে, কী করবে বুঝতে পারছে না। জেলে যাওয়ার আগে গোবিন্দ যখন সার্কাসে খেলা দেখাত তখনও সবাই তাকে ভয় খেত। মাথায় গোবিন্দ লম্বা নয় বটে, তবে তার গায়ে প্রচণ্ড জোরের কথা সবাই জানে। তার ওপর গোবিন্দর হাত-পা চলত বিদ্যুৎ গতিতে। তেমনি ছিল তার প্রচণ্ড রাগ। অমন খুনে রাগও দেখা যায় না। বড়-একটা। গোবিন্দকে তাই কেউ কখনো চটাতে সাহস করত না। আজও তাকে দেখে লোকগুলো ভয়ে ভাবনায় সিঁটিয়ে আছে।
গোবিন্দ মৃদুস্বরে একটা লোককে ডেকে আড়ালে নিয়ে বসল, “সামন্ত মশাইয়ের তবুটা কোন দিকে রে?”
“দেখা করবে গোবিন্দদা?”
“করেই যাই।”
“চলো তাহলে।” লোকটা খুশি হয়ে বলে, “সামন্তমশাই তোমার কথা খুব বলে। বলে, গোবিন্দটা খুন করল বটে, কিন্তু ওরকম খেলোয়াড় হয় না।”
গোবিন্দ একথার জবাব দিল না। বারো-তেরো বছর বয়সে সে সামন্ত মশাইয়ের সার্কাসে চলে এসেছিল। এই সার্কাসের সঙ্গে ঘুরে-ঘুরেই ছোটো থেকে বড় হয়েছে। সে আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সামন্তমশায়ের তাবুটা একটু পিছনের দিকে, আলাদা জায়গায়। তাঁবুর এমনিতে কোনো চাকচিক্য নেই, তবে ভিতরটা বেশ বৈঠকি ঢঙে সাজানো। সেজবাতি জ্বলছে। নিচু একটা তক্তপোষে পুরু গদির বিছানা। তার ওপর বেশ কয়েকটা পুরুষ্টু তাকিয়া। বুড়ো সামন্তমশাই বসে ভাল গন্ধওলা তামাক খাচ্ছে গড়গড়ায়। সামার চেহারা রোগার দিকেই, তবে রুগণ নয়। মাথার চুল কাঁচাপাকায় মেশানো। মত পাকানো গোঁফ। চোখের দিকে চাইলে বুক গুড়গুড় করে। ভয়ডর বলতে কিছু নেই সেই চোখে। তবে লোকে তাকে ভয় খায়, আবার ভালও বাসে। চিরকুমার সামন্তমশাই সারা জীবন তিলে তিলে এই সার্কাসখানা তৈরি করেছে। সার্কাসটাই তার ধ্যান-জ্ঞান। এটা থেকে তার বেশ মোটা লাভও হয়। কিন্তু সেই টাকা কে খাবে তার ঠিক নেই। সামন্ত তাই ইদানীং একটু চিন্তিত।
দুজনে ঘরে ঢুকতেই সামন্ত মুখ থেকে তামাকের নলটা সরিয়ে অল্প আলোয় ঠাহর করে দেখতে-দেখতে বলে, “কে রে? কী চায়?”
গোবিন্দ এগিয়ে গিয়ে ভঁয়ে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়াল। মুখের ঢাকা সরিয়ে বলে “আমি গোবিন্দ, সামন্তমশাই।”
সামন্ত যেন ছ্যাকা খেয়ে সোজা হয়ে বসে। বলে “কে বললি?”
“গোবিন্দ। মনে পড়ছে না?”
“গোবিন্দ।” বলে সামন্ত হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে থাকে। তারপর বলে “তোর না ফাঁসি হয়ে গেছে?”
“হলে আর আসতাম কী করে? “আয় তে, এগিয়ে আয়, আলোতে ভাল করে দেখি।”
গোবিন্দ হাসিমুখে এগিয়ে গেল। দাড়িগোঁফওয়ালা মুখে সেজবাতির আলো পড়ল।
******
রামু ট্রাপিজের খেলা দেখে তাজ্জব। কী সাহস। অন্য সব সার্কাসের মতো এরা নীচে কোনো জালও খাটায়নি। পড়ে গেলে মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে যাবে। হাত-পা ভেঙে “দ” হয়ে যাওয়ার কথা।
“উঃ, কী খেলা গবাদা। আমি ট্রাপিজ শিখব।”
গবা হেসে বলে, “আরো আছে। দেখই না”
ট্রাপিজ শেষ হতেনা-হতেই সাহেবি পোশাক পরা সার্কাসের ম্যানেজার এসে ঘোষণা করল, “আজ আপনাদের আমরা একটা নতুন। খেলা দেখাব। লখিন্দর আর কালনাগিনীর খেলা। জীবন ও মৃত্যুর খেলা। এই খেলায় একদিকে থাকবে আমাদের নতুন এক ওস্তাদ মাস্টার লখিন্দর অন্যদিকে থাকবে একটি বিষাক্ত রাজ-গোখরো। সাপটার বিষদাঁত আমরা কামাইনি। যে-কেউ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সদ্য জঙ্গল থেকে ধরা বুনো সাপ। এ খেলা সবার শেষে।”
রামু রোমাঞ্চিত হল। আজ নতুন খেলা বাঃ, কপালটা ভাল।
এরপর সাইকেল, দড়ি, বাঘ, সিংহ, চোখ বেঁধে ছোরা নিক্ষেপ–একের পর এক হয়ে যেতে লাগল। রামুর আর পলক পড়ে না। বাঘ-সিংহের খেলা দেখে গায়ে রোঁয়া দাঁড়িয়ে গেল তার। লম্বা আর বেটে জোকার দুটোও খুব হাসাল।
সবার শেষে নতুন খেলা।
সব আলো জ্বেলে গোল এরেনাটাকে একেবারে ফাঁকা করে দেওয়া হল। বাজনা বাজতে লাগল অত্যন্ত মৃদু শব্দে। একটা সুরেলা বাঁশির সুর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।
কয়েকজন তোক একটা মস্ত খাঁচা টেনে আনল মাঝখানে। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল, খাঁচার মধ্যে একটা বিশাল ভয়ঙ্কর সাপ বিড়ে পাকিয়ে আছে।
খাঁচার মাথায় একটা লোক বসে আছে।
ম্যানেজার একটা পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, “এবার আসছেন মাস্টার লখিন্দর। কিন্তু আগেই আপনাদের জানিয়ে রাখি, মাস্টার লখিন্দরের মুখ আপনারা দেখতে পাবেন না। কয়েক বছর আগে এক দুর্ঘটনায় ওর মুখটি পুড়ে বীভৎস হয়ে যায়। তার ফলে উনি সব সময়েই মুখোশ পরে প্রকাশ্যে আসেন।”
ঘোষণা শেষ হল। বাজনা মৃদু তরঙ্গে বাজতে লাগল। খাঁচার ওপরের লোকটা ছাড়া বাকি সবাই সরে গেল এরেনা থেকে।