কমেলর আমগাছটা ভাল-ছেলে ধরনের। প্রতি বছর আঁকা ঝকা আম ফলে তাতে,। কাজের লোক, কিছু গম্ভীরও। তাকে রামু গোপালদা বলে ডাকে। রামুর ক্লাসের ফাওঁবয়ের নামও গোপাল, আর গাছটাও গোলাপ-খাস আমের। তবে ফার্স্ট বয়ের সঙ্গে রামুর ভাব নেই, গাছটার সঙ্গে আছে। একটু বর্ণ বিপর্যয় করে নিয়ে গোলাপখাসকে গোপালদা বানিয়ে নিতে রামুর অসুবিধে হয়নি।
এছাড়া কাক, শালিখ, চড়াই, বেড়াল, কুকুর, ইঁদুর, এমনকী কাঠবেড়ালিদের সঙ্গেও রামুরর কোনো শত্রুতা নেই। তারা রামুকে পছন্দই করে। বাড়ির পোষা পায়রাগুলো রামুর মাথায়, কাঁধে নির্ভয়ে এসে বসে। কাঠবেড়ালি তার থেকেই চিনে-বাদাম খেয়ে যায়। গোট চারেক চেনা শালিখ রোজ সকালে পড়ার ঘরে ঢুকে কিচির-মিচির করে তাদের পড়া ভণ্ডুল করে রামুকে সাহায্য করার চেষ্টা করে।
নয়ন পাখির দাঁড়টা বাবার ঘরে দিয়ে আসতে চলে যাওয়ার পর রামুর মনে হল, এই কাকাতুয়াটাকে হাত করা দরকার। বাবা এটাকে কিনেছে রামুকে ঢিট করবার জন্যই। পাখিটাকে হাত না করলে ব্যাটা তাকে বিস্তর জালাবে।
উদ্ধববাবু মক্কেলদের বিদায় করে খাওয়া দাওয়া সেরে যখন ঘরে এলেন তখন অনেক রাত। পাখির দাঁড়টা সিলিং ফ্যান থেকে ঝোলানো একটা দড়িতে বাঁধা। কাকাতুয়া ঘাড় গুঁজে ঘুমোচ্ছে। উদ্ধববাবু নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়লেন।
কিন্তু মাঝরাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। না, দুঃস্বপ্নটা ঠিক দেখেননি তিনি। বরং বলা যায় একটা দুঃস্বপ্ন তিনি শুনলেন। কে যেন বলছে, “ওরে বাবা! কী ভয়ংকর! কী সাংঘাতিক রক্ত! রক্ত!”
এইসব বিদঘুঁটে কথা-শুনে ঘুম ভেঙে গেল। উদ্ধববাবু উঠে বসলেন। তার শ্বাসকষ্ট হতে লাগল। তবু চেঁচিয়ে বললেন, “কী হয়েছে রে? ডাকাত পড়ল নাকি?”
না, ডাকাত পড়েনি। হতচ্ছাড়া সেই পাখিটা। চালের এধারে-ওধারে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। পায়ের সরু শিকলের শব্দ হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য এই, ঘোর শীতকালেও সিলিং ফ্যানটা বাই বাই করে ঘুরছে। সেই সঙ্গে পাখির দাঁড়টাও।
কে পাখা খুলল? কেন খুলল? পাখিটাই বা ওরকম চেঁচাল কেন? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল না।
উদ্ধববাবু উঠে পাখাটা বন্ধ করলেন। পাখিটা খুব কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকে একবার দেখল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, “সাবধান!”
উদ্ধববাবু আর বাকি রাতটা ঘুমোতে পারলেন না। ঠিক করলেন, পাখিটাকে শচীলাল শরমার কাছে বেচেই দেবেন। না হয় তো অন্য কাউকে। বড্ড ঝামেলা।
.
০৫.
দুপুরবেলা বহু দূর থেকে একটা লোক পশ্চিমের চষা খেতের মত্ত মাঠটা পেরিয়ে শহরের উপকণ্ঠে শালবনটার ভিতরে ঢুকল। ঝরা পাতার বনটায় আলোছায়ার চিকরি-মিকরি। গোঁ-গোঁ করে
উত্তরে শীতের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো শুকনো পাতা খসে পড়ছে। লোকটা কাধ থেকে তার খাকি রঙের ব্যাগটা নামিয়ে গাছতলায় রাখল।
তার ব্যাগটা দেখেই বোঝা যায়, লোকটা পর্যটক। তার গালে বেশ ঘন দাড়ি আর গোঁফ। খুব লম্বা নয়, কিন্তু শক্ত মজবুত চেহারা, পরনে মালকোচা মারা ধুতি, গায়ে একটা ফতুয়া আর মোটা সুতির চাঁদর। কাঁধে একটা ভাঁজ করা কুটকুটে কম্বলও আছে। পায়ে খুব পুরু সোলের নাগরা জুতে। হাতে বেতের একটা লাঠি। বয়স বাইশ-তেইশ বা বড়জোর পঁচিশ পর্যন্ত হতে পারে। চোখ দুখানায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। রোদে-জলে ঘুরে-ঘুরে গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে বটে, তবে একসময় সে খুব ফর্সা ছিল তা বোঝা যায়।
লোকটা খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিল। তার পর ব্যাগ থেকে চিড়ে আর গুড় বের করে কয়েকটা শালপাতা বিছিয়ে তার ওপর ঢাকল। সামনেই মটর খেত। উঠে গিয়ে খেত থেকে তাজা মটরশুটি তুলে আনল এক কোঁচড়। জলও জুটে গেল কাছেই এক চাষীবাড়ির কুয়ো থেকে। কোথায় কী জোটে তা লোকটা ভালই জানে।
খাওয়ার পর গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে লোকটা অঘোরে ঘুমোতে লাগল। জঙ্গলে সাপখোপ, পাগলা শেয়াল থাকতে পারে। শীতকালে এই অঞ্চলে চিতাবাঘও হানা দেয়। লোকটা সবই জানে, কিন্তু সূক্ষেপ নেই।
শীতের বেলা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে পশ্চিমের মাঠে সূর্য টুক করে মেঘলা মতো একটা কুয়াশার স্তরের মধ্যে ডুবে গেল। শালবনের মধ্যে ঘনিয়ে উঠল অন্ধকার। আর হাড়-কাঁপানো হিম একটা হাওয়া হুঁ-হুঁ করে বইতে লাগল।
লোকটা চোখ মেলে তাকায়। সে দিনের বেলায় বড় একটা লোকালয়ে ঢুকতে চায় না। চারদিকটা বেশ আঁধারমতো হয়ে এসেছে দেখে লোকটা তার ব্যাগ-ঠ্যাগ গুছিয়ে নিয়ে উঠে পড়ল।
বন পার হয়ে লোকটা কিন্তু শহরে ঢুকল না। শহরের বাইরে মস্ত সার্কাসের তবু পড়েছে। ডিম-ডিম করে বাজনা বাজছে। বাঘ সিংহের হুংকার শোনা যাচ্ছে। ভিড়ে ভিড়াক্কার। চারিদিকে আলো ঝলমল দোকানপাট, বেলুনওয়ালা, ভেঁপুওয়ালা বাঁশিওয়ালা মিলে এক মেলা বসে গেছে।
লোকটা মোটা চাঁদরে নাক পর্যন্ত ঢেকে আর মাথায় একটা কপাল ঢাকা বাঁদুরে টুপি চাপিয়ে একটু সন্তর্পণে তাবুর পিছন দিকে এগোতে লাগল।
এ-পাশটা অন্ধকার। বাঘ সিংহের খাঁচা, রসুইখানা, খেলোয়াড়দের তাবু আর মেলা, দড়ি-দড়া, বাঁশ-কাঠ, প্যাকিং বাক্সের গাদা। লোকটার কোনো অসুবিধে হল না অন্ধকারে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেল।
খেলোয়াড়দের ঢুকবার দরজায় কড়া পাহারা, খুব কম করেও পাঁচ-সাতজন মুশকো লোক দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। খেলা শুরু হতে আর দেরি নেই। দরজার কাছে একটি আলোর চৌখুপি। মুখটকা লোকটা এগিয়ে যেতেই পাহারাদাররা পথ আটকাল, “এই এধারে যাওয়া বারণ। হঠো, হঠো।”