“এই অঞ্চলেরই। তবে পড়াশুনো করতে অনেকদিন বাইরে ছিলাম।”
“ঠিক আছে। আজ থেকেই শুরু করুন।”
রাত্রিবেলা চুপিসারে নয়নকাজল একটা লুচি খাওয়াল কাকাতুয়াটাকে। তারপর বেশ মিষ্টি করে পাখিটার গায়ে হাত বুলিয়ে মিষ্টি গলায় বলল, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলি! সেই টাকাটার কথা, না? কোথায় যেন আছে সেই টাকাটা? বল বাবা।”
পাখিটা ঘাড় বেঁকিয়ে নয়নকাজলকে ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, “টাকা নয়, মোহর। মোহরগুলো….মোহরগুলো…..।”
নয়নকাজল সাপর মতো চোখ করে চেয়ে ছিল পাখিটার দিকে। সাপের মতো গলাতেই বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ মোহর। তা সে মোহরগুলো কোথায় রে বাপ?”
“মোহর আছে…মোহর আছে….মাটির তলায়…..কিন্তু বিশু, তুমি অমন করে তাকিও না…..আমি ভয় পাই…..ভয় পাই।”
চাপা গলায় নয়নকাজল বলে, “ভয় নেই রে! মাটির তলায় তো বুঝলুম, কিন্তু জায়গাটি কোথায়? |||||||||| পাখিটা দাঁড়ে দোল খেতে লাগল। তারপর হঠাৎ হাঃ হাঃ হাসির শব্দ তুলে বলল “জানি, কিন্তু বলব না।”
“বলবি না? বলবি না?” বলতে বলতে নয়নকাজল দুটো হাত সাঁড়াশির মতো করে পাখিটার দিকে এক পা এগিয়ে গেল। পেছনে কখন নিঃশব্দে রামু এসে দাঁড়িয়েছে। দৃশ্যটা দেখে সে অবাক! কিন্তু বিপদ বুঝে সে হঠাৎ বলে উঠল, “নয়নদা। কী হচ্ছে?”
নয়নকাজল চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে একগাল হেসে বলল, “পাখিটাকে বড়বাবুর ঘরে রেখে আসার হুকুম হয়েছে কিনা। তাই দাঁড়টা নিয়ে যাচ্ছিলাম।”
কথাটা রামুর বিশ্বাস হল না। কিন্তু আর কিছু বলল না সে। তবে পাখিটা যে মোহরের কথা বলছিল, তা সে স্পষ্ট শুনেছে।
রামু যে খুবই দুষ্টু ছেলে সে, নিজেও জানে। একবার স্কুলের অঙ্ক স্যার হেরম্ববাবু রেগে গিয়ে তাকে বলেছিলেন “তুই এত পাজি কেন বল তো?”
“আজ্ঞে স্যার, আমার শরীরের মধ্যে সবসময় কে যেন কাতুকুতু দেয়। যখন খুব কাতুকুতুর মতো লাগে, তখন আমার কিছু একটা না করলে চলে না।”
“বটে!” বলে হেরম্ববাবু খুব রেগে গেলেন। রামু ইয়ার্কি করছে ভেবে শপাং শপাং কয়েক ঘা বেতও বসালেন তার গায়ে। তারপর বললেন, “এবার কাতুকুতু টের পাচ্ছিস?”
কিন্তু ইয়ার্কি রামু করেনি। বাস্তবিকই তার শরীরের মধ্যে সবসময় একটু কাতুকুতুর ভাব। কখনো বাড়ে, কখনো কমে। যখন বাড়ে তখন বেহদ্দ কোনো দুষ্টুমি না করলেই নয়। খাঁ-খাঁ দুপুরে সে তখন এলোপাথাড়ি ঢিল ছোঁড়ে, গাছের মগডালে ওঠে, ক্লাসে অন্য ছেলেদের বই খাতা গোপনে ছিঁড়ে রাখে, ক্লাসঘরে ছাগল ঢুকিয়ে দেয়, বাড়িতে রান্নাঘরে গিয়ে রান্না তরকারির মধ্যে নুন ছিটিয়ে দিয়ে আসে। প্রতিবেশীরা তার উৎপাতে অস্থির। রামুর মেজদাদুর সত্তর বছর বয়সেও সটান চেহারা সবকটা দাঁত অটুট, মাথায় কালো কুচকুচে চুল। সেবার মেজদাদু রামুদের বাড়ি বেড়াতে এসে বললেন, “আমার মাথা থেকে পাকা চুল বের করতে পারবি? পার পাকাচুল চার আনা করে পয়সা দেব।”
.
০৪.
দুপুরে খাওয়ার পর মেজদাদু যখন শুয়েছেন তখন রামু চুল বাছতে গেল এবং ঘন্টাখানেকের মধ্যে প্রায় শ’খানেক পাকা চুল বের করে ফেলল। দেখে মেজদাদু তে মূৰ্ছা যান আর।
কী! বাড়ি মাথায় করে চেঁচাতে থাকেন, “ভৌতিক কাণ্ড! ভোতক কাণ্ড! আমি কি রাতারাতি বুড়ো হয়ে গেলুম! ওরে উদ্ধব, শিগগির ডাক্তার ডাক। আমার বুকটা কেমন করেছে, মাথা ঘুরছে, হাত পা কাঁপছে!”
ঠিক সেই সময়ে প্রতিবেশী জামাল সাহেব তার সাদা ধবধবে বিলিতি কুকুরটাকে চেন দিয়ে বেঁধে এনে বাড়িতে ঢুকলেন। দুঃখ করে বললেন, “রেমোর কাণ্ড দেখুন একটু আগে আমার বাসায় গিয়েছিল, হাতে একটা কাচি। কুকুরটাকে খুব আদর করছিল তখন কি ছাই টের পেয়েছি! এখন দেখি পিঠের লম্বা চুলগুলো কেটে একেবারে টাক ফেলে দিয়ে এসেছে।”
বাস্তবিকই তাই। সুন্দর, বড় বড় লোমওয়ালা কুকুরটার পিঠ প্রায় ফাঁকা। উদ্ধববাবু হান্টার বের করলেন, মেজদাদু তখন গিয়ে তাকে আটকে দিয়ে বললেন, “যাই হোক বাবা, মাপ করে দাও। ছেলেমানুষ।”
মেজদাদু যে বাস্তবিকই বুড়ো হননি সেটা জেনেই তিনি তখন খুশি। তবে তার পরেও দিন-দুই তার চুল থেকে কুকুরের সাদা লোম ঝরে পড়ত।
শরীরের এই কাতুকুতুটা নিয়ে রামু মাঝেমাঝে ভাবে। কে যে তাকে কাতুকুতু দেয়! ব্যাটাকে ধরতে না পারলে কিছুতেই আর ভাল ছেলে হওয়া যাবে না।
অবশ্য ভাল ছেলে হওয়ার তেমন কোনো ইচ্ছেও তার হয় না। আর ইচ্ছে করে সারকাসের রিং-মাষ্টার বা ম্যাজিসিয়ান বা প্রেসিদ্ধ তান্ত্রিক বা নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় বা রেলের গার্ড বা মহাকাশচারী বা বহুরূপী বা বিশ্বভ্রমণকারী বা ট্রাক ড্রাইভার বা পাইলট বা ডুবুরি হতে। শুধু লেখাপড়া করে আর নিয়মমতো চলে এর কোনোটাই হওয়া যাবে না। সুতরাং সে ঠিক করেছে, একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। কুমোরপাড়ার গারও পালানোর হচ্ছে। দুজনে প্রায়ই শলাপরামর্শ করে। গান্টুর ইচ্ছে পালিয়ে প্রথমেই উত্তরমেরুতে যাবে। রামুর ইচ্ছে, আফরিকা। দুজনে এখনো একমত হতে পারেনি। হলেই গলা-জড়াজড়ি করে একদিন বেরিয়ে পড়বে।
তবে রামু দুষ্টু হলেও সে গাছপালা আর পশুপাখি খুব ভালবাসে। এমন কী, নিজেদের বাগানের সব কটা গাছের সঙ্গেই তার আলাদা আলাদা রকমের সম্পর্ক আছে। বুড়ো তেঁতুলগাছটার সঙ্গে তার সম্পর্ক দিদিমা আর নাতির। তেঁতুলগাছটাকে সে তিন্তিড়ি দিদিমা বলে ডাকেও। গাছটা যে তাতে সাড়া দেয়, তাও সে টের পায়।