গবা একটু হেসে বলল, “করব। ভেবো না।”
“তাহলে যাই।”
চোখের পলকে লম্বা-লম্বা পা ফেলে সাতনা বাঁ পাশের মাঠটা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রামু গবার সঙ্গে বাড়ি ফিরে এল ভারী মনে।
পুলিশ নতুন করে রিপোর্ট দেওয়ায় গোবিন্দ মাস্টারের মামলা আবার আদালতে উঠেছে। গোবিন্দর পক্ষে সওয়ালে নেমেছেন মস্ত মস্ত ডাকসাইটে সব উকিল। সামন্তমশাই তাদের মোটা টাকা দিচ্ছেন। গোবিন্দ নিজে গিয়ে শহরে ধরা দেওয়ার পর ফের জামিনে খালাস পেয়ে সারকাসে তার খেলা দেখাচ্ছে। মামলার যা গতিক তাতে সে খালাস পাবেই।
কুন্দকুসুম বদলি হয়নি। হঠাৎ চাকরি ছেড়ে সপরিবারে দেশের বাড়িতে চলে গেছে। সেখানে নাকি চাষবাস নিয়ে থাকবে। নতুন যে দারোগা এসেছে, তার নাম চন্দ্রাতপ খাঁড়া। ভারী ভাল লোক। প্রায়ই উদ্ধববাবুর বাড়িতে এসে রামুকে আদর করেন আর কাকাতুয়াকে ছোলা খাওয়ান।
উদ্ধববাবুর হঠাৎ জ্ঞানচক্ষু খুলেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, রাঘব ঘোষ তার চেয়ে ভাল গাইয়ে। তাই আজকাল সন্ধের পর রাঘবের বৈঠকখানায়। গিয়ে বসেন প্রায়ই। চোখ বুজে গান শোনেন আর রিফ করেন, “ওয়াঃ, ওয়াঃ, কেয়াবাত।”
রাঘব ব্যথিত স্বরে বলে, “কেয়াবাতটাও ঠিক জায়গামতো বলতে পারছেন উদ্ধববাবু! বেজায়গায় তারিফ করলে সুর কেটে যায়।”
উদ্ধববাবু ভারী লজ্জা পান।
নয়নকাজলের সঙ্গে এখন আর কাকাতুয়ার আড়াআড়ি নেই। সরকারি লোকেরা গুপ্তধনের প্রায় দু-কলসি মোহর উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। কাকাতুয়াকে তাই এখন হরিনাম শেখানো হচ্ছে। তবে পাখিটার স্মৃতিশক্তি বড়ই প্রবল। ভোর হতে না-হতেই সে ডাকতে থাকে, “রামু ওঠো। রামু ওঠো। মুখ ধোও। পড়তে বসো।”
রামুর মনে বহুদিন ধরেই একটা খটকা লেগে আছে। সে একদিন গবাকে ধরে পড়ল, সেই কিংকর লোকটা সেই রাত্রে যে হাওয়া হয়ে গেল তারপর আর তার দেখা পেলাম না কেন বলো তো! কোথায় গেল সে?”
গবা এক গাল হেসে বলে, “সেই কথাটা কিন্তু খুব গুহ্য কথা। কেউ জানতে পারে!”
“কেউ জানবে না।”
“তবে বলি। সেই যে তোমাকে আলফা সেনটরের কথা বলেছিলুম, মনে আছে?”
“আছে। আলফা সেনটর হল সৌরলোকের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। পৃথিবী। থেকে চার আলোকবর্ষ দূরে।”
“বাঃ, ঠিক বলেছ। সেখান থেকে একদল লোক আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করে যায়, জানো তো!”
“জানি। কিন্তু সে তো গুল।”
“তাহলে বলব না।”
“আচ্ছা, গুল নয়। বলো।”
“আলফা সেনটরের একটা গ্রহের নাম হচ্ছে নয়নতারা। কিংকর হল আসলে সেই গ্রহের লোক। ডাকাতদের সঙ্গে যখন আমরা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলুম না, তখন আমি টেলিপ্যাথিতে নয়নতারায় খবর পাঠাই। খবর পেয়ে কিংকর একদিন একটা মহাকাশযানে চেপে চলে এল। তারপর সব ঠিকঠাক করে দিয়ে সামলে-সুমলে দিয়ে ঘটনার সেই রাত্রে আবার নয়নতারায় ফিরে গেছে।”
“আর তুমি কে গবাদা?”
“আমি? ও বাবা, ও আবার কেমনধারা কথা! আমি হচ্ছি আমি, গবগবাগব পাগলা খুড়ো, উলিঝুলি ফোকলাটেকো নাংলাবুড়ো। ঝুলদাড়ি আর ঝোলা গোঁফে গুমসো ছিরি, নালে-ঝোলে চোখের জলে জড়াজড়ি!”
“তুমি কিন্তু মোটেই বুড়ো নও। বুড়োদের চামড়া এত টান থাকে না।”
“থাকে থাকে। এ কি তোমাদের এই নোংরা জায়গার আধমরা বুড়ো নাকি! এসব মেড ইন অ্যানাদার ওয়ার্ড।”
“তার মানে?”
“কথাটা কিন্তু খুব গুহ্য। গোপন রেখো।”
“রাখব। কিন্তু ফের গুল দিলে!”
“আহা, আগে শোনোই না। কাউকে বেলো না। আমিও আসলে ওই নয়নতারার লোক। সেখানে জল-হাওয়ার এমন গুণ যে, দেড়শো দুশো বছর বয়সে মানুষের যৌবন আসে।”
“ফের গুল?”
“গুল নয় গো। শুনলে প্রত্যয় যাবে না, সেখানে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের লোকেরা হামা দেয়। ত্রিশ-চল্লিশে গিয়ে হাঁটতে শেখে। আধো-আধো বোল ফোটে তখন। সত্তর বছর বয়সে আমাদের হাতেখড়ি। পঁচাত্তর বছর বয়সে ইসকুলের পাঠ শুরু। সেখানে গেলে দেখবে আশি নব্বই বছরের লোকরা ঢিল মেরে আম পাড়ছে, ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, ক্রিকেট খেলছে।”
“সেখানে কি কিংকরদার গাঁয়েই তোমার বাড়ি?”
“হ্যাঁ, তা বলতে পারো একরকম। পাশাপাশি গাঁ। ওর গাঁয়ের নাম বাঘমারি, আমার গাঁ হল কুমিরগড়। দু গাঁয়ের মধ্যে দুরত্ব মাত্র শ-পাঁচেক মাইল, একই থানা আমাদের।”
“বলো কী! পাঁচশো মাইল দূরের গাঁ কি পাশের গাঁ হল নাকি?”
গবা খুব হাসে। বলে, “তোমাদের এখানকার মতো তো নয়। আমাদের গ্রহটাও যে বিশাল। আমাদের একটা জেলা তোমাদের গোটা ভারতবর্ষের সমান। চলো একবার তোমাদের নিয়ে যাব। জামবাটি ভর্তি সরদুধ আর সবরিকলা আর নতুন গুড় দিয়ে মেখে চিড়ের এমন ফলার খাওয়াব না! আর সেই জামবাটির সাইজ কী! ঠিক তোমার ওই পড়ার ঘরখানার মতো…..”
“গুল! গুল!”
“আহা, শোনোই না….”
পরদিনই গবা আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। নয়নতারাতেই ফিরে গেল কি না কে জানে!