“আজ্ঞে আপনি বুঝবেন না তো কে বুঝবে! এমন পাকা মাথা দেশে কটা আছে?”
কুন্দকুসুম বিরক্তির গলায় বলে, “এবার পায়ের গিঁটটা খুলতে পারো কি না।”
গবা জিব কেটে বলে, “ঐ দ্যাখো, কথায় কথায় ভুলেই যাচ্ছিলাম, ইয়ে বড়বাবু, আর-একটা কথা।”
“আরো কথা?”
“মানে সাতনার কাছে কয়েকটা চিঠি আছে। সর্দারের নিজের হাতের লেখা। কোথায় কোন বাড়িতে ডাকাতি করতে হবে, কাকে খুন করতে হবে, এই সব বৃত্তান্ত, সর্দারের হাতের লেখা সেই সব চিঠি সাতনা আবার পুলিশের কাছে পাঠাতে চায়। আমি বলি, তার কি কোনো দরকার আছে বড়বাবু?”
কুন্দকুসুম বিবর্ণ মুখে বলে, “না। তার দরকার নেই।”
গবা সঙ্গে-সঙ্গে বলে, “হ্যাঁ, আমিও তাই বলি। দরকার কী? কেঁচো খুঁড়তে আবার সাপ বেরিয়ে পড়বে। তার চেয়ে চিঠি কটা বরং থাক। পরে কাজে লাগবে।”
কুন্দকুসুম ইঙ্গিত বোঝে। একটু চাপা স্বরে বলে, “তোমরা খুব ঘড়েল।”
“ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন! আপনি থাকতে আমরা? হেঃ হেঃ…”
গবা পায়ের বাঁধনটা খুলে দিলে কুন্দকুসুম উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু অত বড় মানুষটা যেন নুয়ে পড়েছে, বয়সটাও যেন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বেড়ে গেছে।
কুন্দকুসুম ধীরে-ধীরে গিয়ে রণপা দুটো কুড়িয়ে নিল। কারো দিকে একবারও তাকিয়ে রণপায়ে চড়ে লম্বা-লম্বা পা ফেলে জঙ্গলের অন্ধকার আর রহস্যময়তার মিলিয়ে গেল।
.
৩৬.
ঘটনার মাসখানেক পর এক গাঁয়ের রাস্তায় তিনজন হাঁটছিল। গবা পাগলা, সাতনা আর রামু।
একটা পুকুরধার পেরিয়ে কয়েকটা তালগাছের জড়াজড়ি। তারপর একটা বাঁক দেখা যাচ্ছিল। গবা বলল, “ওই বাঁকটা ঘুরলেই যুধিষ্ঠিরের সেই পিসি না মাসির বাড়ি। এসে গেচি হে।”
সাতনার বুকে এখনো ব্যাণ্ডেজ। আঘাত মারাত্মক না হলেও সর্দারের দুটো গুলিই তার পাঁজরে ক্ষত করে দিয়ে গেছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। তার ওপর মেয়েকে দেখতে পাবে সেই আনন্দে তার হাঁফ ধরে যাচ্ছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “কথাটা মনে রেখো গবা, মেয়ের কাছে বাপ বলে আমার পরিচয় দিও না।”
“জানি। বলব দূর-সম্পর্কের আত্মীয়।”
সাতনা একটু ভাবল। তারপর বলল, “তারও দরকার নেই। মেয়ে খুব সম্ভব আমাকে চিনতে পারবে। আবছা হলেও আমার কথা তার মনে আছে। এ-চেহারা তো ভোলার নয়। তার চেয়ে এক কাজ করি এসো। ওই বাঁকের মুখে ঝুপসিআমগাছটার ছায়ায় বসে থাকি। একবার না একবার না একবার সে পুকুরে কিংবা বাগানে বেরোবেই। তখন একটু চোখের দেখা দেখে নেব।”
এ-কথার ওপর গবা কোনো কথা বলতে পারল না। রামুর চোখদুটো ছলছল করতে লাগল। সে ফিরে আসার পর তার বাবা যে আনন্দে কঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে-কথাটা এখন মনে পড়ল তার। বাবাকে আগে তার খুব রাগী আর নির্দয় বলে মনে হত। এখন জানে, বাবা তাকে কত ভালবাসে। সাতনার জন্য তাই তার বড় কষ্ট হচ্ছিল।
গাছতলায় বসে সাতনা অপলক চোখে কিছুক্ষণ সামনের বাগানঘেরা একতলা পাকা বাড়িটার দিকে চেয়ে রইল। কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না। সাতনা গবার দিকে চেয়ে বলল, “তুমি যে আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিলে না, আমি যে কোনো শাস্তি পেলুম না, এটা কি ঠিক হল?”
গবা মৃদু হেসে বলল, “শাস্তি কাকে বলো তুমি? কত চোর-ছ্যাঁচোড় খুনে জালিয়াতকে তো পুলিশ গারদে ভরে। জেল খেটে কি আর তাদের শুদ্ধি হয়। বাপু হে, আমি বুঝি অনুতাপের আগুন না জ্বললে মানুষের পাপ পোড়ে না। অনুতাপ কাকে বলে জানো? কোনো কাজ করে বিচার দ্বারা তার ভালমন্দ অনুভব করে যে তাপের দরুন মন্দে বিরতি আসে তাই হল অনুতাপ। সেই অনুশোচনায় নিজের মেয়েটার সামনে গিয়ে পর্যন্ত তুমি দাঁড়াতে পারছ না। এর চেয়ে বেশি সাজা তোমাকে আর কে দেবে?”
সাতনা ধুতির খুঁটে চোখের জল মুছল।
ঠিক এ-সময়ে একটা দীঘল চেহারার মেয়ে বেরিয়ে এল। সদ্য স্নান করে এসেছে বুঝি। এক রাশ চুল এলো হয়ে আছে পিঠের দিকে। ভারী সুন্দর মুখোনি। একটা ভেজা কাপড় শুকোতে দিচ্ছিল বাইরের তারে।
গবা একটু ঠেলা দিয়ে সানাকে বলল, “দ্যাখো হে, দ্যাখো। দানবের মেয়ে কেমন পদ্মফুলটির মতো দেখতে হয়েছে।”
সাতনা জবাব দিল না। সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইল মেয়ের দিকে। চোখের পলক পড়ে না, শ্বাসও বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে।
ধীরে-ধীরে রোদে একটু পায়চারি করল মেয়েটি। তারপর ভিতর থেকে কেউ বুঝি ডাকল। মেয়েটি সাড়া দিল, “যাই।”
তারপর চলে গেল।
গবা উঠে পড়ল। বলল, “মেয়ের সামনে যদি না-ই যেতে পারো তবে আর মায়া বাড়িও না। দশটা গাঁয়ের লোক তোমাকে চেনে। ধরা পড়লে বিপদ আছে। ওঠো, ওঠো।”
সাতনার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল অঝোরে। উঠে আস্তে-আস্তে ফেরার পথ ধরে সে বলল, “যত খারাপ কাজ করেছি তার দশগুণ ভাল কাজ যদি বাকি জীবনটায় করি, তাহলে মেয়ের সামনে একদিন দাঁড়ানোর সাহস হবে না গবা?”
“হবে। খুব হবে। ইচ্ছেটাই আসল, অনুতাপটাই আসল।”
সাতনা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে, “তাহলে এখান থেকেই আমায় বিদায় দাও ভাই। পৃথিবী জায়গাটা বিশাল, কাজেরও অন্ত নেই। দেরি করে কী হবে। এক্ষুনি শুরু করে দিই গিয়ে।”
গবা মাথা নাড়ল, “এসো তবে।”
সাতনা একটু ভেবে বলল, “আর একটা কথা। মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়েছে। আমার খুব ইচ্ছে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ওর বিয়ে হোক। তুমি ব্যবস্থা করবে?”