কুন্দকুসুম একটা হুংকার দিয়ে বলে, “খুলে দে। তারপর দেখাই তোর ঘাড়ে কটা মাথা!”
“মাথা একটাই, তবে সেটা এত সস্তা নয়। আপনার তো অনেকগুলো মাথা আর মুখ। কখনো দারোগা, কখনো সর্দার। আপনার একটা মাথা গেলেও আর-একটা থাকবে।”
কুন্দকুসুম একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলে, “দারোগাদের মাঝে মাঝে ছদ্মবেশ ধরতেই হয়, তাতে আশ্চর্যের কী? আমি সর্দার এ কথা তোকে কে বলল রে মার্কেট?
“অত চিল্লাবেন না দারোগাবাবু। এখন আপনি একটু অসুবিধের মধ্যেই আছেন। আমরা ছাপোষা লোক সব, দারোবাবুকেও ভয় খাই, ডাকাতের সর্দারকেও ভয় খাই। কিন্তু আপনার স্যাঙাত সাতনা আপনার গুলি খেয়ে ভারী রেগে গেছে। জানেন তো বাঘ জখম হলে বড় বিপজ্জনক। সে এখন আপনাকে গুরু বলেও মানছে না, দারোগা বলেও মানছে না। আপনার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সে এল বলে।”
কুন্দকুসুমকে একটু অস্বস্তি বোধ করতে দেখা যায়। গলা এক পর্দা নামিয়ে বলে, “তোমরা বিশ্বাস করো, এই ডাকাতের দলটাকে অ্যারেস্ট করার জন্য গত তিনমাস ধরে চেষ্টা করছিলাম। আজই প্রথম এদের ডেরার পাকা সন্ধান পাই। আমার ফোর্স এই জঙ্গলটা ঘিরে আছে এখনও। আমি কাপালিকের ছদ্মবেশে–”
এতক্ষণ কিংকর একটাও কথা বলেনি। এবার সে হঠাৎ হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে। কুন্দকুসুম কটমট করে তার দিকে চায়।
কিংকর হাসি থামিয়ে বলে, “আমারও সেটা সন্দেহ হয়েছিল দারোগাবাবু, আপনি বোধহয় সর্দার নন। আসল সর্দার বোধ হয় সত্যিই পালিয়েছে। আপনাকে আমরা ছেড়েও দিতে চাই। তবে তার আগে আমাদের কয়েকটা কথা আছে।”
কুন্দকুসুম গম্ভীর হয়ে বলে, “বলে ফেল।”
কিংকর মাথা নেড়ে বলে, “আমার তেমন সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাস নেই। কথা বলবে গবাদা। আমি তাকে ডেকে আনছি। এই বলে কিংকর জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল চকিত পায়ে।
কয়েক মিনিট বাদে একটু দূরে গবার গলা পাওয়া গেল। সে গান গাইছে? “বলো রে মন কালী কালী। আমার বুকটা করে ধুকুর পুকুর, পেটটা লাগে খালি-খালি। অধিক কী আর কবো রে ভাই, মনেতে মোর আনন্দ নাই। কত নাচন-কোঁদন দেখাইলাম রে, তবু দেয় না যে কেউ হাতে লি।”
সামনে এসেই গবা এক হাত জিব কেটে নিজের কান ধরে বলল, “ছিঃ ছিঃ, কী পাষণ্ড রে তোরা! বড়বাবুকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখেছিস! নরকে যাবি যে রে! খুলে দে! ওরে খুলে দে!”
গবা নিজেই নিচু হয়ে তাড়াতাড়ি কুকুসুমের বাঁধন খুলতে লেগে যায়।
রামু গবাকে দেখেও নড়ে না। তার মনের মধ্যে টিকটিক করে কী যেন একটা হতে থাকে। সে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে শুধু।
গবা কুকুসুমের হাতের বাঁধন খুলে ধরে-ধরে তাকে তুলে বসায়। তারপর সামনে ঢিপ করে মাথা ঠুকে বলে, “বড়বাবু, অপরাধ নেবেন না। ছেলেমানুষ সব, না-বুঝে করে ফেলেছে।”
কুন্দকুসুম গম্ভীর গলায় বলে, “।” গবা নিরীহ গলায় বলে, “মানুষ মাত্রেরই ভুল হয় আজ্ঞে।” কুন্দকুসুম বলে, “তা বটে…”
গবা হাতজোড় করে বলে, “তা সেই ভুলের কথাই বলছিলুম আর কী। ভুল কি দারোগা-পুলিশেরও হয় না? এই আমাদের গোবিন্দ মাস্টারের কথাই ধরুন না। খুন-টুন করার ছেলেই নয়। তবে ফেঁসে গেছে!”
“তাই নাকি?”
“একেবারে নির্যাস সত্যি কথা।” বলতে বলতে গবা কুকুসুমের পায়ের বাঁধনটা খুলবার চেষ্টা করতে করতে বলে, “এঃ, এই গিটটা বড় এঁটে বসেছে দেখছি। ওদিকে আবার সাতনাকেঁদেখে এলুম একটা খাঁড়ায় ধার দিচ্ছে। নাঃ বড় বিপদ দেখছি। পায়ের বাঁধনটা তাড়াতাড়ি না খুললেই নয়…”।
কুন্দকুসুম একটা ধমক দিয়ে বলে, “ইয়ার্কি রাখো। এটা ইয়ার্কির সময় নয়। কী চাও সেটা স্পষ্ট করে বলো।”
গবা মাথা চুলকে বলে, “আপনি দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, গরিবের মা-বাপও বটে। আপনার কাছে আব্দার করে চাইব তাতে আর লজ্জা কী! বলছিলাম, গোবিন্দকে খালাসের একটা ব্যবস্থা করে দিতেই হবে আপনাকে।”
কুন্দকুসুম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “দেখা যাবে।”
“ভরসা দিচ্ছেন তো?”
কুন্দকুসুম একটু বিষাক্ত হেসে বলে, “হাতি কাদায় পড়েছে বাপু, ভরসা দিয়ে যে আমার উপায় নেই সে তুমি ভালই জানো।”
ভারী লজ্জার ভান করে গবা বলে, “কী যে বলেন বড়বাবু! তা দিলেনই যদি, তবে আরো একটু দিন।”
“আবার কী?”
“আজ্ঞে ওই গুপ্তধনের ব্যাপারটা। ওটা সরকারের হক পাওনা।” কুকুসুমের চোখ দুটো হঠাৎ জ্বলে ওঠে।
চাপা গলায় গবা বলে, “প্রাণের দাম যে ওর চেয়ে একটু বেশি বড়বাবু। কিংকর বা সাতনা যেমন লোক, থানা-পুলিশ-কোর্ট-কাছারির তোয়াক্কা করবে না। জানে তো তাতে লাভ নেই। কোন ঝানু উকিল মামলা ঘুরিয়ে আপনাকে খালাস দিয়ে দেবে। তাই ওরা চায় বল্লমে এফেঁড় ওফেঁড় করে চলে যেতে। আমি অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছি।”
কুন্দকুসুম নিভে যায়। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “ঠিক আছে, তাই হবে।”
গবা আবার মাথা চুলকে বলে, “আর একটা কথা।”
“আবার কী?”
“এতই যদি দিলেন তবে আর-একটু বা বাকি থাকে কেন? বলছিলাম, এ-জায়গায় আপনার অনেক দিন চাকুরি হয়ে গেল। আমরা পাঁচজনে দেখছি, এখানকার জল-হাওয়া আপনার তেমন সহ্য হচ্ছে না। শুকিয়ে একেবারে অর্ধেক হয়ে গেছেন। তাই বলছিলুম আজ্ঞে, একটা বেশ ভাল স্বাস্থ্যকর জায়গায় বদলি নিয়ে চলে যান না বড়বাবু।”
কুন্দকুসুম থমথমে মুখ করে বলে, “বুঝেছি।”