গবা পিছনের পুকুর থেকে স্নান করে এসে এক পেট খেয়ে ঘুম লাগাল।
বিকেল হতে না হতেই রামু এসে ঠেলে তুলল, “ও গবাদা! বাবাকে বলে বিষ্ঠুপুরের সারকাসে নিয়ে যাবে বলেছিলে যে! আজই চলো।”
গবা হাই তুলে বলে, দূর! ও একটা সারকাস নাকি? মরকুটে বাঘ,
রোগা হাতি, পালোয়ানের নেই বুকের ছাতি। কাল সকালে গিয়ে দেখি, সরকাসের ম্যানেজার গুণঘঁচে পাটের ফেঁসে ভরে ছেঁড়া তবু সেলাই করছে। তার চেয়ে হবিগঞ্জের সারকাস অনেক ভাল।”
“কী আছে তাতে?”
“ওঃ, সে মেলা জিনিস। বাঘ হাতি সিন্ধুঘোটকের কথা ছেড়েই দিলাম। একটা বেঁটে লোক আছে, সে ভারী হাসায়। বেঁটেটার বন্ধু হচ্ছে একটা তালগাছের মতো লম্বা লোক। তা বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সময় বেঁটেটা একটা মই লাগিয়ে বন্ধুর কাধ-বরাবর উঠে যায়। মজা না?”
“খুব মজা। কিন্তু কবে নিয়ে যাবে?”
“ব্যস্ত হয়ো না বাবুমশাইকে বলে আগে অনুমতি নিই। তারপর একদিন যাব’খন। পয়সা-টয়সাও লাগবে না। হাবিবগঞ্জের সারকাসের সেই বেঁটে লোকটা আমার খুব বন্ধু। দুজনে একসময়ে একই দলে ছিলাম কিনা।”
রামু চোখ কপালে তুলে বলে, “তুমি সারকাসের দলে ছিলে গবাদা? বলোনি তো?”
গবা মৃদু-মৃদু হেসে বলে, “সারকাসে ছিলাম, বেদের দলে ছিলাম। সে অনেক ঘটনা।”
“সারকাসে কী কী খেলা দেখাতে?”
“সবরকম। ট্রাপিজ, দড়ির ওপর হাঁটা, একচাকার সাইকেলে উঠে রকম রকম কসরত, ক্লাউন সেজে রগড়ও করতে হয়েছে।
‘আমাকে খেলা শিখিয়ে দেবে?”
“তা আর শক্ত কী? তবে কঠিন ডিসিপ্লিন চাই, মনোযোগ চাই অধ্যবসায়। চাই।”
“আমি পারব।”
উদ্ধববাবু আজ একটু তাড়াতাড়িই কাছারি থেকে ফিরে এসেছেন। এসেই হাঁক মারলেন, “নয়ন, ওরে নয়ন!”
নয়নকাজল ছুটে এসে বলে, “আজ্ঞে বাবুমশাই।”
“পাখিটা কোথায়?”
“দরদালানে ঝোলানো আছে।”
“হুঁ” বলে উদ্ধববাবু পকেট থেকে শচীলাল শর্মার চিঠিটা বের করে আর একবার পড়লেন। তারপর ক্রু কুঁচকে বললেন “পাখিটাকে খুব সাবধানে রাখা দরকার। আজ থেকে ওটাকে এ-ঘরে রাখবি। আমি না থাকলে দরজায় সবসময় তালা দেওয়া থাকবে বুঝেছিস?”
“আজ্ঞে।” নয়নকাজল খুব বিনীতভাবে বলল, তবে এসময় উদ্ধববাবু লক্ষ করলে দেখতে পেতেন যে, নয়নকাজলের চোখ দুটো চকচক করছে। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো চেটে নয়ন বলল, “আজ এক বিটকেল সাধু এসে পাখিটার ওপর খুব হামলা করে গেছে। নিয়েই যেত, আমি গিয়ে সময়মতো আটকালাম বলে।”
“সাধু!” বলে উদ্ধববাবু হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলেন, “সাধুর সঙ্গে পাখির কী সম্পর্ক?”
মাথা চুলকে নয়ন বলে, “আজ্ঞে সে তো জানি না”।
উদ্ধববাবু রেগে গিয়ে বলেন, “এবাড়িটা কি হাট নাকি? যে-কেউ এসে ঢুকে পড়বে, হামলা করবে, তোরা সব করিস কী? সাধু পাখিটা নিয়ে যাচ্ছিল নাকি?”
“তাই মতলব ছিল। বিশাল চেহারা দেখলেই ভয় হয়।”
“ধরতে পারলি না?”
“ও বাবা, ধরবে কে? হাতে যা একখানা ধারালো শূল ছিল!”
উদ্ধববাবু একটু চিন্তিত মুখে বললেন, “ঠিক আছে, এখন থেকে সাবধান থাকবি।”
বাইরের কাছারি ঘরে মক্কেলরা জড়ো হতে শুরু হয়েছে। কাজেই পাখি নিয়ে ভাববার সময় উদ্ধববাবুর নেই। তিনি তৈরি হয়ে কাছারিঘরে গিয়ে বসলেন এবং মামলামকদ্দমার মধ্যে ডুবে গেলেন।
সন্ধের সময় যখন সবাই পড়তে বসে তখনই রামুর ভীষণ ঘুম পায়। এত ঘুম যে কোথায় থাকে? কেবল হাইয়ের পর হাই উঠতে থাকে, চোখের দুটো পাতায় যেন আঠা-মাখানো চুম্বক লাগিয়ে দেয় কে। শ্রীধর মাস্টারমশাই পড়াতে এসে ভীষণ রাগারাগি করেন রোজ। মারধরও প্রায় রোজই খেতে হয় রামুকে। কিন্তু পড়তে তার একদমই ভাল লাগে না।
আজও তিন ভাই পড়তে বসেছে। রামু ঘন ঘন দেওয়ালঘড়িটার দিকে চাইছে। ঠিক ছটায় শ্রীধরবাবু আসবেন। ততক্ষণ যতটা পারে ঢুলে নেওয়ার জন্য সে মুখে অ্যাটলাসটা চাপা দিয়ে চোখ বুজে রইল।
কিন্তু কে জানে কেন আজ রামুর ঘুম আসছিল না। বারবারই তার চোখে একটা সারকাসের দৃশ্য ভেসে উঠছে, সে দেখছে, একটা ছেলে ট্রাপিজ থেকে আর একটায় ঝাঁপ দিয়ে চলে যাচ্ছে, দড়ির ওপর হাঁটছে। একচাকার সাইকেল কসরৎ দেখাচ্ছে। ছেলেটা অবশ্য সে নিজেই। আজ তার মনে হল, সারকাসের খেলোয়াড় হতে না পারলে জীবনের কোনো মানেই নেই।
এদিকে ছটা বেজে গেল। ক্রমে সাড়ে ছটাও বাজে। কিন্তু শ্রীধরবাবু এলেন না। এরকম অঘটন কখনোই ঘটে না, শ্রীধরবাবুর মতো নিয়মনিষ্ঠ লোক কমই আছে। কামাই তো নেইই, এ মিনিট দেরিও করতে নারাজ। আজ তবে হল কী?
সন্ধে সাতট নাগাদ কাছারিঘরে উদ্ধববাবুর কাছে একটা লোক এসে বলল, “শ্রীধরবাবু সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকেছেন। ক’দিন আসতে পারবেন না।”
মামলা-মকদ্দমায় ডুবে-থাকা উদ্ধববাবু অবাক হয়ে বললেন, “কে শ্রীধরবাবু? কিসের মামলা?”
“মামলা নয়। শ্রীধরবাবু আপনার ছেলেদের পড়ান।”
“অ, তা কী করে পড়লেন?”
“সাইকেলে টিউশানি করে আসছিলেন এমন সময় একটা মোটর সাইকেল এসে তাকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। খুব চোট হয়েছে। ডান পায়ের হাড় সরে গেছে।”
“তাই তো! খুব দুঃখের কথা।”
পরদিন সকালেই অবশ্য শ্রীধরবাবু চিঠি দিয়ে একটি লোককে পাঠালেন। চিঠিতে লেখা, “আমার বদলে এই ভ ভদ্রলোক ছেলেদের ক’দিন পড়াবেন। ইনি তিনটি বিষয়ে এম. এ. পাস।”
উদ্ধববাবুর আপত্তির কারণ ছিল না। শ্রীধরবাবু যাকে পাঠিয়েছেন তার যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্নই ওঠে না। লোকটির চেহারাও বেশ ভালমানুষের মতো। নাম যুধিষ্ঠির রায়। আগে এঁকে কখনো দেখেন নি উদ্ধববাবু। জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি এই অঞ্চলের লোক?”