কিংকরের দম শেষ। সে হাঁফাতে হাঁফাতে কিছুক্ষণ দম নিয়ে টর্চ আর রিভলভার তুলে নেয় মাটি থেকে। দুটোই সর্দারের। রিভলভারটা তুলে ধরে সে আদেশ দেয়, “সর্দার, লড়াই ছাড়ো। ধরা দাও।”
সর্দার একবার তার দিকে তাকায়। তারপর আচমকা প্রতিপক্ষকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিচু হয়ে ভোজবাজির মতো জঙ্গলের আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে যায় চোখের পলকে।
কয়েক মুহূর্ত বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে কিংকর সর্দারের অনুসরণ করার জন্য পা বাড়ায়। সেই সময়ে কামিনীঝোঁপের ওপাশ থেকে চলতে চলতে উঠে দাঁড়ায় সাতনা। টর্চের আলোয় দেখা যায়, রক্তে তার বুকের বাঁদিক ভেসে যাচ্ছে। বুকে হাত চেপে ধরে সাতনা হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, “সর্দারের রনপা আছে। পশ্চিমধারে একটা শুড়ি পথ ধরতে হলে সেদিকে যাও, সাবধান।” ….বলে সাতনা আবার ঢলে পড়ে।
কিংকর আর দু’নম্বর লোকটা তৎক্ষণাৎ পশ্চিমদিকে ছুটে যায়।
শুড়ি পথটার ধারেই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন। রামু আর নয়নকাজল। রামুর হাতে কয়েকটা আধলা ইট।
নয়ন বলল, “তোমার ঢিলটা সর্দারের কপালে লেগেছে। নইলে এতক্ষণে কিংকরের হয়ে যেত। কী টিপ তোমার! আর কি সাহস!”
রামু রাগের গলায় বলে, “কিন্তু তুমি অত কাপছ কেন? এত ভয়টা কিসের?”
“ও বাবা! এরা সব সাংঘাতিক লোক। ঢিলটা মেরে তুমি ভাল কাজ করোনি। সর্দার জানতে পারলে তোমাকে আঁস্ত রাখবে না।
“অত সস্তা নয়। তুমি চুপ করে থাকো তো।”
“দেখলে তো নিজের চোখে তিন-তিনটে জোয়ান সর্দারকে কাবু করতে পারল না। তুমি বাচ্চা ছেলে কী করতে পারবে?”
“আর কিছু না করতে পারি ঢিল মারতে পারব। তুমি অত ভয় পেয়ে।”
নয়ন মাথা চুলকে বলে, “বুঝলে দাদাবাবু, আমি খুব-একটা ভিতু ছিলুম। এই ডাকাত হওয়ার পর থেকেই ভয়টা বেড়েছে। ওরে বাপরে! ওটা কি! রাম রাম বলতে বলতে নয়ন মাটিতে বসে দু’হাতে মুখ ঢাকে।
রামু প্রথমটায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। ভাল করে তাকিয়ে দেখল, শুড়ি পথটার মুখে ভীষণ ঢ্যাঙা এক মূর্তি হনহন করে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। কম করেও বারো ফুট লম্বা। আবছায়ায় ভাল দেখা যায় না। কিন্তু ভুল নেই।
রামুর রনপায়ে চড়া অভ্যেস আছে। সুতরাং প্রথমটায় ঘাবড়ে গেলেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। সর্দার রনপায়ে চড়ে পালাচ্ছে।
রামু শুড়ি পাথটার মাঝখানে এগিয়ে গিয়ে মূর্তিটার মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর বোঁ-বোঁ করে তার দুটো ঢিল ছুটে গেল নির্ভুল নিশানায়।
রনপায়ে লোকটা একটু থমকে গেল। রামু ভেবেছিল, বুঝি লাগেনি। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে মূর্তিটা হঠাৎ টলতে টলতে ধড়াস করে পড়ে গেল।
সেই সঙ্গেই ছুটে এল কিংকর আর সেই লোকটা। কিংকরের হাতে টর্চ। কিংকর চেঁচিয়ে বলল, “শাবাশ রামু!”
একটু বাদে সকলেই ঘিরে দাঁড়াল সংজ্ঞাহীন সর্দারকে। কিংকর শক্ত দড়ি এনে সর্দারের হাত-পা বেঁধে ফেলে। বলে, “বড় সাংঘাতিক লোক, বাঁধা না থাকলে জ্ঞান ফিরে আসার পরই গণ্ডগোল পাকাবে।”
রক্তাম্বর এবং দাড়িগোঁফে সর্দারকে বাঁধা অবস্থাতেও ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
দ্বিতীয় লোকটা আসলে গোবিন্দ। সে এসে রামুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার এলেম আছে। আমার যা বিদ্যে সব তোমাকে শিখিয়ে দেব।”
রামু মুখ তুলে বলে, তুমি একা কেন গোবিন্দদা? গবাদা আসেনি।”
মৃদু একটু হেসে গোবিন্দ বলে, “গবাদাও এসেছে। একটু তফাতে আছে। পাগল মানুষ তো। এসে পড়বে কিছুক্ষণ বাদে।”
কিংকর সর্দারকে বাঁধার পর মুখের ওপর ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে আস্তে আস্তে তার নকল দাড়িগোঁফ টেনে খুলছিল। খুলতে খুলতে বলল, “এ লোকটাও চেনা লোক। কিন্তু কিছু করার নেই। ধরিয়ে দিলেও কেউ বিশ্বাস করবে না যে, এ সর্দার ছিল।”
“নিজেই দ্যাখো।”
রামু টর্চের আলোয় দাড়িগোঁফহীন সর্দারের মুখের দিকে চেয়ে হাঁ হয়ে যায়। এ যে আন্দামান আর নিকোবরের বাবা, দারোগা কুন্দকুসুম।
রামু কঁপতে কাঁপতে বলে, “ইনিই সর্দার?” কিংকর মাথা নাড়ে, “ইনিই।”
.
৩৫.
কুন্দকুসুম যখন চোখ মেলে তাকাল, তখনো সকলের অবাক ভাবটা যায়নি, যাকে বলা যায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। হাত-পা-বাঁধা কুন্দকুসুম কিন্তু একটুও ঘাবড়াল না। চারদিকে চেয়ে নিজের অবস্থাটা একটু বুঝে নিল কয়েক সেকেণ্ডে। কিংকরের হাতে একটা মশাল জ্বলছে। তার মস্ত আলোয় সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
কুন্দকুসুম রামুর দিকে চেয়ে মৃদু একটু হাসল। তারপর বলল, “তুমি উদ্ধববাবুর ছেলে রামু? আন্দামান আর নিকোবরের বন্ধু?”
রামু এত ঘাবড়ে গেছে যে, গলায় শব্দ এল না। শুধু মাথা নাড়ল।
কুন্দকুসুম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তোমার টিপ খুব ভাল। আজ তোমার জন্যই সর্দার প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল আর কী! শেষ অবধি অবশ্য পালাতে পেরেছে। কিন্তু বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারবে না।”
এ-কথা শুনে রামুর মাথা একদম গুলিয়ে গেল। বলে কী লোকটা? তাহলে কি কুন্দকুসুম সর্দার নয়?
কুন্দকুসুম চারদিকে আর-একবার চোখ বুলিয়ে রামুকে জিজ্ঞেস করে, “এরা সব কারা বলো তো! আর আমাকে এমনভাবে বেঁধেছেই বা কে? কার এত সাহস?”
গোবিন্দ একটু হেসে বলল, “সেলাম দারোগাসাহেব। কিছু মনে করবেন না, নিজেদের জান বাঁচাতে আপনাকে একটু বাঁধতে হয়েছে।”