হামাগুড়ি দিয়ে মিনারের ও-পিঠে চলে এসেছে কিংকর। সর্দারের পিছন দিকে মাত্র হাত পাঁচেকের মধ্যে এসে থেমেছে সে। অপেক্ষা করছে।
সর্দার সাতনার দিকে এক পা এগিয়ে গেল। বলল, “সাতনা, এখনো বলছি, ফিরে আয় আমার দিকে। গুপ্তধনের পথ মিলেছে। দুজনে মিলে ভাগ করে নেব। আর উঞ্ছবৃত্তি করতে হবে না।”
সাতনা এক-পা পিছু হটে বলে, “দল ভেঙে দেবে?”
“দিতেই হবে। ডাকতরা চিরকাল ডাকাত থাকে না। দুনিয়ার নিয়মে ভোল পালটাতে হয়।”
সাতনা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে, “তুমি ভোল পালটাতে পারো সর্দার, কারণ তোমার আসল পরিচয় আজও কেউ জানে না। কিন্তু আমরা দাগি লোক, আমরা ভোল পালটাতে চাইলেও পারব না।”
অসাবধানে সানা ভারী ঢালটা এক হাত থেকে অন্য হাতে নিতে গিয়েছিল। পলকের সেই অসতর্কতাই কাল হল তার। সর্দারের রিভলভার গর্জে উঠল। একটা নয়, দু হাতে দুটো।
“আঃ!” বলে চেঁচিয়ে সাতনা উবু হয়ে বসে পড়ল মাটিতে। ঢালটা ছিটকে গেছে একধারে। আর আড়াল নেই।
সর্দার রিভলভার তুলে ভাল করে নিশানা করছে। আর তখনই তার ঘারে চিতাবাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল কিংকর।
.
৩৪.
কিংকর ঝাঁপিয়ে পড়ল বটে কিন্তু সর্দারকে নাগালে পেল না। সর্দার তো সোজা লোক নয়, সাতনার মতো দানবও তাকে খামোখা সমঝে চলে না। পিছন দিকে যেন-বা সত্যিই তার আর দুটো চোখ আছে। কিংকরও কঁপ দিয়েছে, তৎক্ষণাৎ সর্দারও তড়িৎগতিতে সরে গেছে। কিংকর পড়ল মাটিতে, মুখ থুবড়ে।
সর্দার তার রিভলভার সোজা কিংকরের মাথায় তাক করে সাতনাকে বলল, “তোর অস্ত্র ফেলে দে। নইলে তোর এই প্রাণের ইয়ারকে শেষ করে দেব।”
সাতনা কিংকরের অবস্থাটা দেখল। বোকার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পস্তাচ্ছে। কিংকর সর্দারের হাত মারা পড়লে সাতনার শোক করার কিছু নেই। কিন্তু ভয় একটাই। কিংকর মরলে জীবনেও আর মেয়েটার খোঁজ পাওয়া যাবে না। সাতনার এখন ধ্যানজ্ঞান তার মেয়ে। একবারে তাকে চোখের দেখা দেখতেই হবে। তারপর মরে গেলেও দুঃখ নেই। কিন্তু এখন যে সংকটে তারা রয়েছে তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আশা দেখছে না সাতনা। সর্দারের হাতে দুজনকেই না মরতে হয়।
সাতনা জানে, সর্দারকে গুলি করার উপায় নেই। এখন আর গুরু বলে সর্দারকে খাতির না করলেও চলে। কারণ সর্দার বিনা কারণে তার দিকে গুলি চালিয়েছে। এখন উলটে গুলি চালালে সাতনার অপরাধ হয় না। কিন্তু তাও সম্ভব নয়। একটু নড়লেই কিংকরের মাথাটা সর্দারের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। আর অস্ত্র ৫ ল দিলেও যে রেহাই পাওয়া যাবে তা নয়। সর্দার দুজনকেই মারবে। সুতরাং এই শীতেও সাতনা ঘামতে লাগল।
সর্দার দুম করে একটা গুলি চালিয়ে দিল। কিংকরের মাথার মাটি ছিটকে গেল খানিকটা। একটু হেসে সর্দার বলে, “এখনো ভেবে দেখ সাতনা, খুব। বেশি সময় পাবি না। পরের গুলিটা ওর খুলি ফাটিয়ে দেবে।”
সর্দারের মস্ত টর্চের আলো অনেকটা ছড়িয়ে পড়েছে কিংকরের চারধারে। সেই আলোয় সাতনাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সাতনার আর সর্দারের মাঝখানে কেবল একটা বেঁটে কামিনীঝোঁপ। সাতনা ক্ষীণ স্বরে বলল, “দিচ্ছি।”
কিংকরের নড়াচড়ার নাম নেই। এমন ভঙ্গিতে শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে, যেন বা একটু বাদেই ওর নাকের ডাক শোনা যাবে। অসহায় সাতনা তার আগ্নেয়াস্ত্রটা সর্দারের পায়ের কাছে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
বেচারা! প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই রিভলভার থেকে আগুন ঝাঁকিয়ে ওঠে। সাতনা তার পাঁজর চেপে ধরে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সর্দারের রিভলভারের নল চকিতে কিংকরের দিকে ফেরে।
চোখে পলক ফেলার মত একটুখানি দেরি হলে হয়তো কিংকর বেঁচে থাকত না। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে নির্ভুল নিশানায় একটা হট সাঁ করে সর্দারের কপালে লাগে। সর্দার থমকে যায়। বাঁ হাতখানা কপালে চেপে ধরে। কিন্তু পড়েও যায় না, মূৰ্ছাও হয় না।
ততক্ষণে কিংকর উঠে দাঁড়িয়েছে। খুব-একটা তাড়াহুড়ো করল না সে। শাবলটা কুড়িয়ে নিল শান্তবাবে। তারপর সর্দারের ডান হাতের কব্জিতে আলতোভাবে মারল। রিভলভারটা পড়ে গেল। দু-পা এগিয়ে কিংকর সর্দারের মুখে একখানা ঘুষি চালাল।
সর্দার পড়ল না। এমন কি নড়লও না এতটুকু। হাত বাড়িয়ে সে কিংকরকে প্রায় মাথার ওপর তুলে ছুঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা করল দূরে। কিন্তু কিংকর তো ঘাসজলে খায় না। সর্দার যখন তাকে দুহাতে টেনে ওপরে তুলছে তখনই সে তার দুখানা পায়ে ফুটবল-খেলোয়াড়ের মতো দুটে শট কষাল সর্দারের মুখে আর পেটে।
সেই দুটো লাথিতে যে-কোন শক্তসমর্থ লোকেরও জমি নেওয়া উচিত। কিন্তু সর্দারের কাছে তা বোধহয় পিঁপড়ে কামড়ের শামিল। সে শুধু ‘উম’ করে একটা বিরক্তির শব্দ করল। তারপরই উলটে এক ঘুষি মারল কিংকরকে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে মুখটা সরিয়ে নিয়েছিল কিংকর।
তারপরই শুরু হল দুজনের ধুন্ধুমার লড়াই।
কে জিতত, কে হারত তা বলা মুশকির। কিন্তু হঠাৎ ঘটনাস্থলে আর একজন লোকের আবির্ভাব হল। মজবুত গড়ন। মাঝারি লম্বা। সে এসেই একটানে কিংকরকে সরিয়ে আনল সর্দারের থাবা থেকে। তারপর নিজে লাফিয়ে পড়ল সর্দারের ওপরে।
এই দু’নম্বর লোকটা লড়তে জানে। মিনিটদুয়েক পরই দেখা গেল, সর্দার হাঁফাচ্ছে। লড়াইয়ের তাল পাচ্ছে না। যতবার ঘুষি লাথি চালায় ততবার তা বাতাস কেটে বেরিয়ে যায়। কুস্তির প্যাঁচে যতবার লোকটাকে কাবু করার চেষ্টা করে ততবার লোকটার পাচে পড়ে যায়।