দুজনে যখন আবার মিনারটার কাছে এল, তখন ওপরটা অন্ধকার। কোনো ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে না।
মিনারের গোড়ার দিকে চৌকো-চৌকো পাথর গাঁথা। তার ওপর নকশা। টর্চ জ্বেলে কিংকর পরীক্ষা করে দেখল, সব নকশাই একরকম। কোন্টা নির্দিষ্ট পাথর এবং তাতে কী চিহ্ন আছে তা বোঝা মুশকিল। কিংকর হাঁটু গেড়ে বসে তন্ন-তন্ন করে খুঁজতে থাকে। বহু পুরনো আমলের নকশাগুলো সব ক্ষয় হয়ে এসেছে। তবু কিংকর বুঝবার চেষ্টা করে।
আচমকা ওপর থেকে আবার এক ঝলক টর্চের আলো এসে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে গুলির আওয়াজ। দুজনের খুব কাছাকাছিই গুলি দুটো মাটিতে গেঁথে যায়। সাতনা অন্ধকারে কী একটা জিনিস মাথার ওপর তুলে ধরে। কিংকর তাকিয়ে দেখে, মস্ত একটা লোহার ঢাল। ছাতার মতো বড়। পুরনো আমলের ভারী জিনিস দেখে একটু হাসে সে, সাতনার বুদ্ধি আছে।
ওপর থেকে পর-পর আরো দশ-বারোটা গুলি ছুটে আসে। দু-চারটে টকাটক ঢালের ওপরও এসে পড়ে।
সাতনা চাপা গলায় বলে, “সর্দার নেমে আসছে মনে হয়। তাড়াতাড়ি করো।”
কিংকর নিশ্চিন্ত গলায় বলে, “আমরা দুজন, ও একা। ভয় কী?”
সাতনা মৃদু একটু হেসে বলে, “সর্দারকে চেনো না তাই বলছ। দু-দশ জনের মহড়া নেওয়া সর্দারের কাছে জলভাত। আমার এই লোহার মতো। পাঞ্জা একবার সর্দার একটু চেপে ধরেছিল। তখনই বুঝেছিলুম, এর সঙ্গে ইয়ার্কি নয়।”
কিংকর এসব কথায় কান দেয় না। মন দিয়ে খুঁজতে থাকে। অনেক নিরিখ-পরখ করে তার মনে হয়, একটা পাথরের একটা কোনায় যেন খুব অস্পষ্ট একটা তীরের চিহ্ন আছে। খুবই অস্পষ্ট আন্দাজ। তবু এখন অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া ছাড়া উপায়ও তো নেই। শাবলটা পাথরের খাঁজে ঢুকিয়ে গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে চাড় দিতে লাগল সে।
ঠিক এই সময়ে হাত দশেক ওপর থেকে সর্দারের রিভলবার দু ঝলক আগুন ওগরায়। এখন এত কাছ থেকে তার নিশানা ভুল হয় না। ঢাল ঘেঁষে দুটো গুলিই কিংকরের পায়ের কাছে গেঁথে যায় মাটিতে।
কিংকর মুখ তুলে সাতনাকে বলে, “হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? পালটা গুলি চালাও।”
সাতনা মাথা নেড়ে বলে, “তা হয় না। ভাল যোক মন্দ হোক, সর্দার আমার গুরু। তাকে মারতে পারব না।”
কিংকর হাত বাড়িয়ে বলে, “তবে আমাকে অস্তরটা দাও।”
“তাও হয় না। আমার অস্ত্র দিয়ে ওকে মারা চলবে না।”
“তা বলে ওই পাষণ্ডটার হাতে মরবে নাকি?”
“আমার চেয়ে সর্দার তো বেশি পাষণ্ড নয়। দুজনেই সমান পাপী, তাহলে কে কার বিচার করবে বলো!”
ঢালের আড়াল থেকে খুব সাবধানে মুখ বের করে কিংকর ওপরের দিকে চেয়ে দেখল একটু। প্রকাণ্ড একটা ছায়ামূর্তি প্রায় বাদুড়ের মতো ঝুলে ঝুলে নেমে আসছে। মিনারের অগভীর খাঁজে স্রেফ আঙুলের সাহায্যে শরীরের ভার নিয়ে নেমে আসা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এ কাজ পারে সার্কাসের বাজিকররা। সর্দার নামছেও বেশ তাড়াতাড়ি। একবার থেমে একটা হাত ঘুরিয়ে নীচের দিকে তাক করল যেন। সাঁত করে ঢালের আড়ালে মাথা টেনে নেয় কিংকর। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা গুলি এসে মাটি ছিটকে দেয় খানিকটা। একটা রিভলবারে এত গুলি থাকার কথা নয়। কিংকর অনুমান করল, সর্দারের কোমরে অন্তত গোটা চারেক রিভলবার আছে। একটার গুলি ফুরোলে আর একটা চালাচ্ছে।
শাবলে আর একটা চাড় দিতেই পাথরটা নড়ে উঠল। শাবল টেনে নিয়ে পাথরের অন্য ধারে ঢুকিয়ে আবার চাড় দেয় কিংকর। পাথরটা আলগা হয়ে ঢকঢক করে নড়ে। শাবল ফেলে দু হাতে মত পাথরের চাইকে ধরে টান দেয় কিংকর।
ধড়াম করে পাথরটা খসে পড়ে মাটিতে। আর সেই মুহূর্তে প্রকাণ্ড বাঘের মতো সর্দারও লাফ দিয়ে নামে নীচে। নেমেই রিভলভার তুলে বিকট গলায় হাঁক দেয়, “খবর্দার! প্রাণে বাঁচতে চাস তো পালা। মাত্র দশ সেকেণ্ড সময় দেব। পালা!”
ঢালের নিরাপদ আড়ালে থেকেও সেই স্বরে একটু কেঁপে ওঠে সাতনা। কিন্তু কিংকর কাপে না। পাথরটা হঠাৎ খসে আসার ফলে টাল সামলাতে না পেরে সেও পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। কিন্তু খাড়া হওয়ার কোনো চেষ্টা না করে সে নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে মিনারের আড়ালে সরে গেল। সর্দার বোকা নয়। দশ দিকে তার চোখ ঘোরে। তবু কিংকর শেষ একটা চেষ্টা করতে চায়। লোভে আর উত্তেজনায় এখন হয়তো সর্দারের মাথার ঠিক নেই।
সর্দার গম্ভীর গলায় বলে, “সাতনা পিস্তল ফেলে দে।”
সাতনা কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, “সর্দার, তোমাকে গুরু বলে মানি। কিন্তু জান নিয়ে টানাটানি হলে আমাকেও অস্ত্র ধরতে হবে।”
সর্দার একটা পেল্লায় মাটি কাঁপানো ধমক দিয়ে বলে, “চোপ শয়তান। সর্দারের পিছন থেকে ছোবল মারতে চেয়েছিলি, তার সাজা কী জানিস?”
“জানি।”
“সেই ছুঁচো কিংকরটা কোথায়?”
“আমার সঙ্গেই আছে।”
“যদি নিজের ভাল চাস তো সরে যা। আগে ওটাকে খুন করব। তোর বিচার তার পরে।”
সাতনা নরম গলায় বলল, “শোনো সর্দার। তোমাকে আমি তোমাকে আমি এমনিতে মারতে পারি না। সেটা অধর্ম হবে। তবে যদি একই জমিতে দাঁড়িয়ে ভগবানের আকাশের নীচে আমাদের মারার চেষ্টা করো, তাহলে কিন্তু গুলি তোমার দিকেও ছুটবে। রিভলবার আমার হাতেও তৈরি।”
সর্দার একটু চুপ করে থেকে এক পর্দা গলা নামিয়ে বলে, “মেয়ের কথা ভেবে তুই দুর্বল হয়ে পড়েছিলি। তোর মাথা গুলিয়ে গেছে। সেইজন্য তোকে আমি এবারের মতো মাপ করে দিচ্ছি। একটা কথা মনে রাখিস, কাছেপিঠের একশো গাঁয়ে আমার চর আছে। তোর মেয়ে যদি বেঁচে থাকে, তবে তাকে আমি খুঁজে দেব। ভাবিস না।”