কিংকর একথার জবাব দিল না চট করে। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, “তোমার কি ধারণা, সর্দার তোমার ওপর নজর রাখছে?”
সাতনা মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। কিন্তু মনে-মনে যেই ঠিক করেছি যে, সর্দারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব, তখনই মনে ভয়টা এল। কোন্ মানুষের মনে কী আছে তা সর্দার মুখ দেখলেই টের পায়।”
কিংকর মৃদুস্বরে বলল, “মানুষের মুখে যে তার মনের কথা লেখা থাকে। সর্দার তো আর অন্তর্যামী ভগবান নয়, সে শুধু তোমাদের চেয়ে আর এক ডিগ্রী বেশি চালাক। এ-লাইনে আমার গুরু হল শংকর মাঝি। সে তোমাদের মতো নোংরা ডাকাত নয়। টাকা-পয়সা সোনাদানায় লোভ নেই। সারাদিন জপ-তপ নাম-ধ্যান নিয়ে থাকে। লোকের ওপর কখনো খামোখা হামলা করে না। শুধু অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়ায়। লোভ-লালসা নেই বলে তার মনটাও পরিষ্কার। চোখটাও পরিষ্কার তোমাদের সর্দারের চেয়ে লোকের মন বোঝবার ক্ষমতাও তার বেশি। শংকর মাঝি একবার আমাকে বলেছিল, পাপী তাপী খুনে গুণ্ডা বা বদমাশদের ফাঁসিকাঠে ঝোলালে বা জেলে ভরে রাখলেই কি আর তাদের ঠিক-ঠিক সাজা হয় রে? লোকটার মনে অনুতাপ জাগাতে পারলে বরং সেইটেই ঠিক শাস্তি। একটা ডাকাতকে যদি ভালো করে তুলতে পারিস তবে দেখবি তার মত মানুষই হয় না।
সাতনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি শংকর মাঝির দলে কতদিন ছিলে?”
“বছর-দুই। তার কাছে অনেক কিছু শিখেছি।”
সাতনা একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলে, “অনেক কিছু শিখেছ বটে, কিন্তু আগুন নিয়ে এই খেলাটা না খেললেও পারতে। আমার মেয়ের খবর এনে আমাকে দুর্বল করে ফেলেছ, কিন্তু তা বলে তো আর বড় সর্দারের মন গলবে না। তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর মন্ত্রটা কে তোমাকে এখন শেখাবে?”
কিংকর নির্ভীক গলায় বলে, “বড় সর্দার ভগবান নয়, আগেই বলেছি। যত ক্ষমতাই থাক, তারও কিছু দুর্বলতা আছে, ভয় আছে। একবার তার মুখোশটা খুলতে দাও, তখন দেখবে।”
মাথা নেড়ে সাতনা বলে, “মুখোশ বা মুখ কোষ্টা তা আমিও জানি না। শুধু জানি, সর্দার মস্ত তান্ত্রিক। মারণ উচাটন বশীকরণ সব জানে। মানুষের মনের কথা টের পায়। আর জানি, পুলিশ বা গভর্মেন্টের সাধ্য নেই যে তাকে ধরে। তুমি তার ডেরায় ঢুকে মস্ত ভুল করেছ। তুমি পুলিশের লোক গভর্মেণ্টের চর তা জানি না। শুধু জানি, যাই হয়ে থাকো, সর্দারের হাত থেকে রেহাই পাবে না।”
কিংকর হাত নেড়ে প্রসঙ্গটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমার একটা শর্ত ছিল, নির্দোষ গোবিন্দ মাস্টারকে খুনের দায় থেকে রেহাই দিতে হবে। সেটা ভেবে দেখেছ?”
সাতনা বিষাক্ত গলায় বলল, “আমাকে তার জন্য কী করতে হবে।”
“দায়টা তোমাকে নিজের ঘাড়ে নিতে হবে।”
“নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু যে মামলা বহুকাল আগে চুকেবুকে গেছে, আসামির ফাঁসির হুকুম পর্যন্ত হয়ে গেছে তা আবার কেঁচে গণ্ডুষ করতে আদালত চাইবে কি? তা ছাড়া আমি স্বীকার করলেই তো হবে না, আদালত চাইবে প্রমাণ। তার ওপর আসামী জেলহাজত থেকে পালিয়েছে, সেটাও তোমত অপরাধ। পুলিশ তাকে এত সহজে ছাড়বে না।”
“সে আমরা বুঝব। তুমি তোমার কাজটুকু করলেই হবে।”
“করব। এখন আমাকে আমার মেয়ের কাছে নিয়ে চলো।”
ট্যাক থেকে একটা মস্ত পকেট-ঘড়ি বের করল কিংকর। ঝুঝকো অন্ধকারে অনেকক্ষণ তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে থেকে সময়টা ঠাহর করল। তারপর বলল, “আর আধঘণ্টা। তারপর কিছু কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ব দু’জনে।”
সাতনা সন্ত্রস্ত হয়ে বলে, “সময় দেখলে কেন? কিসের আধঘণ্টা?”
কিংকর মৃদুস্বরে বলল, “তোমার যেমন দলবল আছে আমারও তেমনি একটা ছোট্ট দল আছে। তাদের আজ রাত্তিরে এখানে পৌঁছানোর কথা।”
সাতনা অস্ফুট একটা শব্দ করে দুহাতে মুখ ঢাকল। মিনিটখানেক বাদে মুখ তুলে বলল, “তার মানে কী? তুমি কি লড়াই করতে চাও?”
কিংকর মাথা নেড়ে বলল, “না। লড়াই হবে না। তোমার যে কয়জন স্যাঙাত আছে, তাদের ঠেকিয়ে রাখবে তুমি। আমরা বিনা লড়াইয়ে যুদ্ধ জিতে তোমাদের বেঁধে নিয়ে যাব। আর তাহলে বড় সর্দারের মনে তোমার সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ আসবে না।”
“বড় সর্দারকে কি ছেড়ে দেবে তাহলে?”
কিংকর অন্ধকারেও একটু হাসল। “না। বড় সর্দারের জন্য আমি তো রয়েছি।”
“কে বলল নেই?” কিংকর আবার একটু হাসে। মৃদুস্বরে বলে, “আমি যে বড় সর্দারের গায়ের গন্ধ পাচ্ছি।”
আর ঠিক এই সময়ে একটা মস্ত কণ্টিকারির ঝোঁপের ওপাশ থেকে একটা ভারী পায়ের শব্দ আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে লাগল।
সাতনা পাথর হয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ শ্বাস ফেলতে পর্যন্ত ভুলে যায়। কিংকর মৃদু হেসে বলে, “কী হে, বিশ্বাস হল?” সানার মুখে বিস্ময়ে কথা এল না। শুধু মাথা নাড়ল।
কিংকর স্বাভাবিক গলাতেই বলে, “তোমার মতো সর্দারও আমাকে বিশ্বাস করেনি। সারাক্ষণই আবডাল থেকে নজর রেখেছিল।”
“তবু ভয় পাচ্ছ না?”
“না। কিন্তু আমার আর সময় নেই। তুমি ওঠো, স্যাঙাতদের গিয়ে বলল, গায় একটা ছোটখাটো হামলা হবে। তারা যেন বাধা না দেয়। বাধা দিলে রক্তের গাঙ হয়ে যাবে।”
সাতনা উঠল। অসহায়ভাবে বলল, “আর বড় সর্দার?”
“তার কথা আমার খেয়াল আছে। তুমি ভেবো না। যাও।” সাতনা দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে ভাঙা কেল্লার দিকে এগোতে লাগল।
তার ছায়ামূর্তির দিকে ক্ষণকাল চেয়ে রইল কিংকর। তারপর ট্যাকঘড়িটা আর-একবার দেখে নিয়ে খুব টানা নিচু পর্দায় একটা শিস দিল। এমনই সে শব্দ যে, জঙ্গলের অন্যান্য শব্দের মধ্যে ঠিক ঠাহর হয় না।