আজ সকালেই ডাকাতরা তার গলা কাটতে গিয়েছিল বটে, কিন্তু আজই আরার কী মন্ত্রে যেন তারা ভারী সদয় হয়েছে তার ওপর। সকাল থেকে কিছু খেতে দেয়নি। কিন্তু বেলা দশটা নাগাদ একজন নরম-সরম চেহারার ডাকাত এসে জামবাটি-ভরা সর-ঘন দুধ কলা আর নতুন গুড় দিয়ে মাখা চিড়ের ফলার খাওয়াল। তারপর ঘরের দরজা খুলে দিয়ে বলল, “যাও খোকা, ঘুরে-টুরে বেড়াও গিয়ে। তোমাকে আর ঘরে আটকে রাখার হুকুম নেই।”
রামু বেরিয়ে এল। চারদিকে আলো আর গাছপালা। মুক্ত বাতাস। বুক ভরে শ্বাস টানল সে। ডাকাতরা কেন সদয় হয়েছে তা বুঝতে পারল না।
ছেড়ে দিলেও রামুর পিছু-পিছু ছায়ার মতো একজন পাহারাদার রেখেছে। এরা। ভাঙা প্রকাণ্ড বাড়িটার সব জায়গায় যাওয়া বারণ। লোকটা মাঝে-মাঝে পিছন থেকে সাবধান করে দিচ্ছে, “ওদিকে যেও না খোকা। না না, ওই কুঠুরিতে উঁকি মেরো না।”
ঘুরতে ঘুরতে নয়নদার সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল রামুর। নয়নকাজল দিব্যি হাসিমুখে পিছন দিককার একটা বাগনে রোদে বসে গায়ে সর্ষের তেল মালিশ করতে করতে একজন রোগা-পটকা পশ্চিমা ডাকাতের সঙ্গে ভাঙা হিন্দিতে কথা বলছিল। “ছাপরা জিলা হাম খুব চিনতা। ওদিকে খুব ভাল দুধ মিলতা।”
রামু চেঁচিয়ে ডাকল, “নয়নদা।”
নয়ন একগাল হেসে বলল, “তোমাকেও ছেড়ে দিয়েছে? যাক বাবা! আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম।”
রামু কাছে গিয়ে বসে একটু নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, কিংকর লোকটা কে বলো তো?”
নয়ন নিশ্চিন্ত গলায় বলে, “সাংঘাতিক ডাকাত। এ সাতনার চেয়েও ভয়ংকর।”
“তা তো বটে, কিন্তু তোমার চেনা-চেনা লাগছে না?”
নয়নকাজল একটু ভেবে বলল, “তুমি কথাটা বললে বলেই বলছি, আমারও মনে ওরকম একটা ভাব হয়েছিল। লোকটাকে যেন কোথায় দেখেছি। তারপর ভাবলাম, দেখলেও সে-কথা মনে না রাখাই ভাল। লোকটা এক নম্বরের বিশ্বাসঘাতক। আমাদের কাল রাতে ধরিয়ে দিল। আর-একটু হলেই পালাতে পারতাম।”
রামু বিষণ্ণ মুখে বলে, “পালিয়ে লাভটা কী হত? বাড়ি গিয়েও তো রক্ষা পেতাম না। তুমিও না, আমিও না।”
নয়ন চিন্তিত মুখে বলে, “তা বটে।”
“লোকটা হয়তো আমাদের ভালর জন্যই ধরিয়ে দিয়েছে। হয়তো এর পিছনে কোনো কারণ আছে। লোকটা জানত, পালিয়েও আমরা বেশিদূর যেতে পারব না। গেলেও বাঁচব না এদের হাত থেকে।”
নয়ন খুব মিনমিন করে বলল, “আমি অত ভেবে দেখিনি। কিন্তু এখন তুমি বলার পর দ্যাখো ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।”
“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে নয়নদা, কিংকর লোকটা আমাদের শত্রু নয়।”
“না হলেই ভাল। ওরকম লোক যার শত্রু হবে, তার অনেক বিপদ।”
দুপুরে স্নান করে রামু আর নয়ন একটা ছোটোখাটো ভোজ খেল আজ। নতুন একটা ঘরে খড়ের ওপর পাতা নরম বিছানায় দুজনে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে নিল অনেকক্ষণ। কাল রাতে অনিদ্রা গেছে। যখন উঠল, তখন বেলা ফুরিয়ে এসেছে। রামু দেখল তার বালিশের পাশে একটা ছোট্ট চিরকুট এক টুকরো পাথর চাপা দেওয়া। তাতে লেখা, “আজ রাতে সজাগ থেকো।”
আশা আর ভরসায় রামুর বুক ভরে উঠল। সে নয়নকাজলকে ঠেলে তুলে দিল। তারপর চিরকুটটা দেখিয়ে বলল, “আমার মনে হয় এটাও সেই কিংকরের কাজ।”
ঠিক রাত দুটোয় সানা চোর-কুঠুরিতে হাজির হল। সারাদিন কেঁদে কেঁদে তার চোখ লাল। মুখের চামড়া ঝুলে পড়েছে কিছুটা। বেশ নড়বড়ে আর বুড়ো দেখাচ্ছে দানবের মতো লোকটাকে।
চোর-কুঠুরিতে কোনো আলো নেই। জমাট অন্ধকার। কিন্তু সাতনা মৃদু একটু শ্বাসের শব্দ শুনে বুঝল, কিংকরও হাজির।
গলা খাঁকারি দিয়ে সাতনা ডাকে, “কিংকর। “বলো।”
“এখানে নয়। বড় সর্দারের হাজারটা চোখ, হাজারটা কান। চলো, জঙ্গলের দিকে যাই।”
“তথাস্ত। তোমার লোকজন আজ কেমন পাহারা দিচ্ছে?”
“পাহারা নেই। বেশির ভাগই গেছে কাছের একটা গঞ্জে ডাকাতি করতে। বাদবাকিদের আমি ছুটি দিয়েছি।”
“তাহলে চলো।”
দুজনে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ে। তারপর আগে সাতনা এবং তার পিছনে কিংকর ছায়ার মতো জঙ্গলে গিয়ে ঢোকে।
নিস্তব্ধ জঙ্গলাকীর্ণ একটা জায়গায় এসে দুজনে দাঁড়ায়।
সাতনা বসে। মুখোমুখি কিংকর। সাতনা বলে, “আমি রাজি।”
“ভাল করে ভেবে বলো।”
“ভেবেই বলছি। দুনিয়ায় ওই মেয়েটা ছাড়া আমার কেউ নেই। মেয়েটা চুরি যাওয়ার পর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার মাথায় খুন চেপেছিল। সারকাস ছেড়ে ডাকাতের দলে নাম লিখিয়েছিলাম। আজ সারাদিন ভেবে দেখলাম, মরতে একদিন হবেই। তার আগে যদি সুযোগ পাই, মেয়েটার একটা হিল্লে করে দিয়ে যাই। একবার তাকে চোখের দেখাও তো দেখতে পাব।”
“তা পাবে।”
“যখন ছোট্টটি ছিল, তখন সারাদিন আমার বুকের সঙ্গে লেগে থাকত মেয়েটা। মা-মরা মেয়ে। তাকে বুকে করে সারকাসের সঙ্গে দেশ-বিদেশ ঘুরতাম। মেয়েটাই ছিল আমার জীবন, আমার শ্বাসের বাতাস আমার নয়নের মণি।”
“জানি সাতনা।”
“সকলেই জানত। জানত, সাতনার মেয়েই সাতনার সর্বস্ব।”
“এবার বড় সর্দারের নামটা বলো সাতনা।” সাতনা একটু চমকে উঠল।
.
৩২.
সাতনার মতো ডাকাবুকো লোককে আঁতকে উঠতে দেখে একটু হাসল কিংকর। মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল, “ভয় পাচ্ছ?” সাতনা চারদিকে ভাল করে চেয়ে দেখল। তারপর ফ্যাঁসফ্যাসে গলায় বলল, “পাচ্ছি। আমার আয়ু আর বেশিদিন নয়। আজ অবধি সর্দারের চোখকে কেউ ফাঁকি দিতে পারেনি। আমিও পারব না। তবু জেনেশুনে যে হাঁড়িকাঠে গলা দিচ্ছি, তার কারণ আমার কাছে আর নিজের প্রাণের দাম নেই। শুধু একটাই সাধ। মরার আগে যেন মেয়েটার মুখ একবার দেখে যেতে পারি।”