বলতে বলতে সাতনা উঠে দাঁড়াল।
“না সাতনা, তোমাকে ভোলানোর ক্ষমতা আমার নেই। এই দ্যাখো–” বলে পিছন থেকে ডান হাত বের করে কিংকর তার বালাপোশের কোটের ভিতর দিকে হাত ভরে একখানা ফোটো বের করে আনল।
সাতনা হাঁ করে চেয়ে দৃশ্যটা দেখে বলল, “হাত খুলে ফেলেছ! তোমাকে বলেছিলাম না চালাকি করার চেষ্টা করলে-”
কিংকর অমায়িক একটু হেসে বলে, “আমার হাত কিছুতেই বাঁধা থাকতে পারে না, বুঝলে! আপনা থেকে খুলে বেরিয়ে আসে। যাকগে, আবার না হয় বাঁধতে বলে দাও।”
সাতনা জানে, সে-চেষ্টা বৃথা। হাত বাড়িয়ে সে ফোটোটা নেয়। অবিশ্বাসের সঙ্গে চেয়ে থাকে ফোটোটার দিকে। চোরকুঠুরিতে শুধু একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি। দিয়ে আসা আলোতেও ফোটোর মেয়েটির মুখ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় সাতনা। তার মেয়ে চুরি যায় পাঁচ-ছ বছর বয়সে। এই মেয়েটির বয়স তেরো-চোদ্দ বছর। কিন্তু কী হুবহু মিল। তার মেয়েটা বেঁচে থাকলেও এই বয়সীও হওয়ার কথা। সে জিজ্ঞেস করল, “এটা কতদিন আগেকার ফোটো?”
“গত বছরে। তোমার মেয়ের বয়স এখন চোদ্দ বা পনেরো।”
“আর কোনো প্রমাণ আছে?”
“আছে। তবে তা দিয়ে আর তোমার দরকার কী? আমার কথা বিশ্বাস করতে পারো। এ তোমারই মেয়ে এবং সে বহাল তবিয়তে বেঁচেও আছে।”
সাতনা ভাল করে কথা বলতে পারছিল না বারবার টোক গিলছে। চোখে জল আসছে। অত বড় সা-জোয়ান লোকটার হাত দুটো কাঁপছে থরথর করে। সে জিজ্ঞেস করল, “আমার মেয়ে কোথায়?”
“সেইটে এখন বলতে পারছি না।”
“বলো!” বলে সাতনা প্রকাণ্ড দুটো হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল কিংকরকে। একটা রামঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “শিগগির বলো। নইলে মেরে ফেলব।”
কিংকর নিজের শরীরটাকে একটু মোচড় দিয়ে সরে গেল। তারপর বিদ্যুৎগতিতে হাতটা তুলে সাতনার ঘাড়ে হাতের চেটোর ধার দিয়ে একটা কোপ মারল।
“আঁক্” করে একটা শব্দ হল শুধু। তারপর হাতির মতো বিশাল শরীর নিয়ে সাতনা ঢলে পড়ল মেঝের ওপর।
কিংকর ঘরের কোণে একটা জলের কুঁজো অনেকক্ষণ আগেই লক্ষ্য করেছে। এখন সেইটে তুলে এনে সাতনার চোখেমুখে জলের ছিটে দিতে পাগল।
একটু বাদেই চোখ মেলে উঠে বসল সাতনা।
কিন্তু এ এক অন্য সাতনা।
৩১-৩৬. ধীর গম্ভীর স্বরে সাতনা বলল
ধীর গম্ভীর স্বরে সাতনা বলল, “যে-হাত আমার গায়ে তুলছে, সে-হাত তোমার শরীর থেকে কেটে ফেলা হবে।”
কিন্তু সাতনা মুখে যা-ই বলুক, তার আর সেই ভয়ংকরতাও নেই। মুখটা কেমন ভোতা দেখাচ্ছে। চোখে একটা দিশেহারা ভাব। কিংকর একটু হেসে বলল, “ভয় দেখাচ্ছ নাকি? তোমার আমার জীবন যেরকম, যাতে কাউকে কারো ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। খামোকা চোখ রাঙিয়ে নিজের কাছে নিজেই হাস্যাস্পদ হচ্ছ। ভয় খাওয়ার হলে এতক্ষণে খেতাম।”
সাতনাও সেটা ভালরকমে টের পাচ্ছে। কিংকর কিছুতেই ভয় পাচ্ছে না। তাই সাতনা খানিকটা চুপসে গিয়ে বলল, “আমার মেয়ের ছবি যদি খাঁটি হয়ে থাকে, যদি জাল-জোচ্চুরি না করে থাকে তবে এ-যাত্রায় তুমি প্রাণে বেঁচে যাবে। এখন বলো, আমার মেয়ে কোথায়?”
কিংকরের মুখ থেকে এখনো হাসি মুছে যায়নি। সে মাথা নেড়ে বলল, “ধীরে বন্ধু, ধীরে। অত তাড়া কিসের? তোমার শরীরে যে একটু নামমাত্র মায়াদয়া এখনো অবশিষ্ট আছে, তা ওই মেয়েটির জন্য, তা জানি। কিন্তু আমারও শর্ত আছে।”
সাতনা থমথমে মুখে বলল, “সেটা না-বোঝার মতো বোকা আমি নই। শর্তটা কী তা বলে ফ্যালো।”
“এক, দলের যে মাথা, তার নাম আমাকে বলতে হবে।”
“তার নাম জেনে কি হবে? ধরিয়ে দেবে?”
“সেটা পরে ঠিক করব। আগে নামটা’ত জানি।”
“আর কোন শর্ত আছে?”
“আছে। তোমাকে দল ছাড়তে হবে।”
সাতনা একটু ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। “তোমার শর্তগুলো শুনতে ভাল কিন্তু কাজের নয়। প্রথম কথা, দলের বড়-সর্দারের নাম আমারও জানা নেই। দুনম্বর কথা হল, দল ছাড়া অসম্ভব। এ-দলে ঢোকা যায়, বেরোনো যায় না।”
কিংকর হাসি-মুখে বলল, “আমার তিন নমবর শর্ত হল, কোনো নির্দোষকে সাজা দেওয়া উচিত নয়। তাই বেচারা গোবিন্দ মাস্টারকে খালাস দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”
সানা মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “যদি এর কোনো শর্তই না মানি?”
কিংকর এবার হাসল না। মৃদু স্বরে বলল, “তোমার যে-মেয়ে যাওয়ার পর তুমি মানুষ থেকে পশু হয়েছ, সেই মেয়ের খোঁজ জীবনেও পাবে না।”
সাতনা স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ কিংকরের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর কেমন ভ্যাবলার মতো বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। অনেকক্ষণ বাদে বলল, “রাত দুটোর সময় আবার এই চোর-কুঠুরিতে এসো। কথা হবে।”
“কিন্তু বাইরে যে-সব যমদূত মোতায়েন আছে তারা আবার পিছু নেবে না তো?”
“বারণ করে দিচ্ছি। এখন তুমি স্বাধীন।”
দুজনে বেরিয়ে এল।
সাতনার মুখ নিচু। ভাবছে। মাঝে-মাঝে হারানো মেয়েটার কথা ভেবে চোখে জল আসছে তার। হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছছে মাঝে-মাঝে, সাতনার চোখে জল! ব্যাপারটা তার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না।
এই কিংকর নামে লোকটা কে, তা ভেবে সারাদিন রামুর মাথা গরম। গতকাল রাতে জঙ্গলের অন্ধকারে প্রথম দেখা। লোকটা তাদের ধরিয়ে দিল। কিন্তু আজ সকালে আবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তাকে বাঁচাল। সাতনা
যখন তাকে ডাকিয়ে নিয়ে লোকটাকে চিনতে পারে কি না জিজ্ঞেস করল, তখন তার স্পষ্টই মনে হল, যে কিংকরকে চেনে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারল না, কোথায় দেখেছে বা কবে।